দেশ বিদেশে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ভাষাশহীদদের স্বরণ

  • শ্রদ্ধার ফুলে ভরে উঠেছে সারা দেশের শহীদ মিনার।
  • কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের ঢল।
  • ভাষাশহীদদের প্রতি প্রেসিডেন্ট ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।
  • ভাষাশহীদদের প্রতি হাইকমিশনার ও মেয়রের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।

লন্ডন, ২১ ফেব্রুয়ারি- হৃদয়ে একুশের চেতনা ধারণ করে বিনম্র শ্রদ্ধা, মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে এবং ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে শুক্রবার দেশ বিদেশে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়েছে। একুশের প্রথম প্রহরে ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা ১ মিনিট বাজতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শুরু হয় এই শ্রদ্ধা নিবেদন। সূর্য ওঠার আগেই ভোরে শুরু হয় খালি পায়ে প্রভাতফেরি। আবালবৃদ্ধবনিতা সবার মুখে মুখে সেই গান- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’। ফুলের ডালা, গাঁদা-গোলাপের মালা আর হাতে হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে শহীদ মিনারে ছিলেন হাজারো মানুষ। শহীদ মিনারের বেদিতে ফুল দেন রাজনৈতিক, সামাজিক, পেশাজীবী ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিশু-কিশোররাও শ্রদ্ধা জানান। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানুষের ঢল নামে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে আসা সর্বস্তরের মানুষের লাইন আরও দীর্ঘ হয়। হাতে ছোট ছোট পতাকা, ফুল নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার মানুষ শহীদ মিনারে আসেন। ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হয় সারা দিন। দেশের সব শহীদ মিনারে ভরে ওঠে শ্রদ্ধার ফুলে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের এই চিত্র দেখা গেছে।

দিবসটি উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রভাতফেরি সহকারে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভা, কালো ব্যাজ ধারণ, জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত, কালো পতাকা উত্তোলন, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। দিবসটি পালনে কেউ ‘জাতিসংঘে বাংলাকে দাপ্তরিক ভাষা করার দাবি’, কেউ ‘আদালতসহ দেশের সর্বস্তরে বাংলা চালু, কেউ চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা’ এবং কেউ ‘গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এক ভিন্ন আবহে ভাষা শহীদদের স্মরণ করছে দেশের মানুষ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করে শহীদ মিনার এলাকার দেয়ালে জায়গা করে নিয়েছে গ্রাফিতি। কোনো কোনো দেয়ালের উপরে ব্যানার বসানো হয়েছে, যেগুলোয় বিভিন্ন গান ও কবিতার লাইন কিংবা নানা স্লোগানে একুশকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। 

শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) প্রথম প্রহরে ভাষাশহীদদের স্মরণে জাতীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা ১২টা ১২ মিনিটে শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় অমর একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ বাজানো হয়। শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। ফুল দেওয়া শেষে শহীদ মিনার ত্যাগ করেন প্রধান উপদেষ্টা। এর আগে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। ১২টা ২ মিনিটে তিনি শহীদ মিনারে ফুল দেন। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান উপদেষ্টা শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রধান বিচারপ্রতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ শ্রদ্ধা জানান।  তারপর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তারপর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা শ্রদ্ধা নিবেন করেন। এরপর তিন বাহিনীর প্রধানগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। দিবসের প্রথম প্রহর রাত ১২টার আগে প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন শহীদ মিনারে এলে শিক্ষার্থীরা ‘গো ব্যাক গো ব্যাক, চুপ্পু গো ব্যাক’, ‘শেখ হাসিনার দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘এক দুই তিন চার, চুপ্পু তুই গদি ছাড়’, ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’ ইত্যাদি স্লোগান দেন। কেউ কেউ প্রেসিডেন্টকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার দালাল হিসেবে অবিহিত করে ‘ফিরে যাও’, ‘ফিরে যাও’ ‘তোমাকে আমরা চাই না’ চিৎকার করে। বিক্ষোভ পরিস্থিতির মধ্যেই ফুল দেওয়া শেষে ১২টা ৩ মিনিটে তিনি শহীদ মিনার ত্যাগ করেন।

এবার দেশের সর্বস্তরের মানুষ মুক্ত পরিবেশে, নিয়ন্ত্রণহীনতায় ভয়মুক্ত চেতনায় ভাষা শহীদদের স্মরণ করেছেন। জাতীয় শহীদ মিনার কেন্দ্রীক রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি সারাদেশে বিনম্র শ্রদ্ধায় দিবসটি পালিত হয়েছে। বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, এমনকি গ্রাম পর্যায়ের শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান স্কুল-কলেজ-মাদরাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ সর্বস্তরের মানুষ। দিল্লিতে পালিয়ে থাকা শেখ হাসিনা রেজিমে দীর্ঘ দিন সাধারণ মানুষ মুক্ত পরিবেশে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে আসতে পারতেন না। জাতীয় দিবসটিতে সবকিছু শেখ মুজিব বন্দনা এবং আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীক করা হতো। আওয়ামী নিয়ন্ত্রণে বাধায় পড়ায় সাধারণ মানুষ মুক্তমনে শহীদদের স্মরণ করতে পারতেন না। এবার হাসিনা পালানোর পর স্বাধীনভাবে আমজনতা শহীদ দিবস পালন করেছে।

বাংলাদেশে একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল সরকারি ছুটি। দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সঠিক নিয়মে, সঠিক রং ও মাপে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। দিবসটি পালন উপলক্ষে জাতীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন উপলক্ষে ঢাকা শহরের বিভিন্ন সড়কদ্বীপে ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা জনক স্থানগুলোতে বাংলা ভাষার বর্ণমালা সম্বলিত ফেস্টুন দ্বারা সজ্জিত, বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং অন্যান্য স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে একুশের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার এবং ভাষা শহীদদের সঠিক নাম উচ্চারণ, শহীদ দিবসের ভাবগাম্ভীর্য রক্ষা, শহীদ মিনারের মর্যাদা সমুন্নত রাখা, সুশৃংখলভাবে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ ইত্যাদি জনসচেতনতা মূলক বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যমগুলোতে প্রয়োজনীয় প্রচার করে।

এদিকে বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের দেশে দেশে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের সব মিশনেই দিবসটি উদযাপনে নানা আয়োজন করা হয়। প্রবাসীরা বিদেশের মাটিতে অস্থায়ী শহীদ মিনার গড়ে বিনম্র শ্রদ্ধা জানান ’৫২ এর ভাষা শহীদদের প্রতি। এমনকি বিশ্বের অনেক দেশে বিদেশী তথা ভিন্ন ভাষাভাষিরাও বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দিবসটি পালন করেন।

পূর্বলন্ডনের আলতাব আলী পার্কের শহীদ মিনারের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্যে দিয়ে ভাষা শহীদদের স্মরণে বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশিরা। দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হওয়ায় এই দিবসের কারিগর বাঙালির ভাষা শহীদদের স্মরণ করতে অন্যভাষাভাষি মানুষজনও সমবেত হয়েছিলেন পূর্ব লন্ডনের শহীদ মিনারে। যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম ও টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল’র নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমানের পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে রাত ১২.০১ মিনিটে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। হাইকমিশনার ও মেয়রের পর পুষ্পস্তবক অর্পণ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কমিটি, যুক্তরাজ্য বিএনপি, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ, যুক্তরাজ্য জাসদ, যুক্তরাজ্য জাতীয় পার্টি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই এসোসিয়েশন, অখণ্ড বাংলাদেশ আন্দোলন, বেঙ্গল রিসার্চ সেন্টার ও টিচার্স এসোসিয়েশনসহ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে এলে যুক্তরাজ্য বিএনপি‘র নেতাকর্মীরা ‘আমলীগ, ভূয়া; যুবলীগ, ভূয়া; ছাত্রলীগ, ভূয়া’, ‘আমলীগের চামড়া, তুলে নিবো আমরা’, ‘পলাতক খুনিরা, হুশিয়ার সাবধান’, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার দালালেরা, হুশিয়ার সাবধান’, ‘ফাঁসি ফাসিঁ ফাঁসি চাই, শেখ হাসিনার ফাঁসি চাই’, ‘মোদির বউ নাই, হাসিনার জামাই নাই’, ‘পলাইছেরে পলাইছে, মোদির বউ পলাইছে’, ‘পলাইছেরে পলাইছে, খুনি হাসিনা পলাইছে’, ‘পলাইছেরে পলাইছে, স্বৈরাচার পলাইছে’, ইত্যাদি স্লোগান দেন। এসময় শেখ রেহানার ক্যাশিয়ারখ্যাত যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী পার্কের বাইরে এলে যুক্তরাজ্য যুবদলের কর্মীরা তাকে ঘেরাও করে।  পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।

রাত সাড়ে ১১টার পর থেকেই বিভিন্ন সংগঠন মিছিল সহকারে শহীদ মিনারে সমবেত হতে থাকে। স্থানীয় কাউন্সিল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে এ সময় শহীদ মিনারের কড়া নিরাপত্তায় বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় বিভিন্ন সংগঠন সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে গিয়ে পূষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদ মিনারে।

পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে অবস্থিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ছাড়াও যুক্তরাজ্যের ওল্ডহাম, বার্মিংহাম, লুটন ও নিউক্যাসেলসহ বিভিন্ন শহরে অমর একুশে উদযাপিত হয়েছে। একুশের প্রথম প্রহরে প্রতিটি শহীদ মিনারে নেমেছিল জনতার ঢল।

Share this content:

Post Comment

অন্যান্য