জামায়াত আমিরের ‘আওয়ামী-প্রেম’, কমিউনিটিতে অসন্তোষ!
আবদুল ওয়াহিদ তালিম, লণ্ডন, ১৪ নভেম্বর: যুক্তরাজ্য সফরে এসে বুধবার (১৩ নভেম্বর) পূর্ব লণ্ডনে ব্রিটিশ-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্টিজের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে জামায়াতের আমির ডাঃ শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘আমি বার বার ফ্যাসিজম আর ফ্যাসিস্ট সরকার (আওয়ামী লীগ সরকার) এটা বলাও পছন্দ করি না। কারণ ওরাওতো (আওয়ামী লীগ) আমাদের পরিবারের সদস্য। রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য।’ জামায়াত আমিরের এমন বক্তব্যে কমিউনিটিতে অসন্তোষ চলছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্কের ঝড় চলছে। অবৈধ ও অনৈতিক আওয়ামী লীগ সরকার দেশে যে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিলো, দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে স্বৈরাচারী সরকার যে মানুষের গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার হরণ করেছিলো, গুম-খুন, লুটপাট সহ যে ভয়াবহ অপকর্মের নজির স্থাপন করেছিলো, তাতে তারা কোনভাবেই সহানুভূতি পেতে পারে না- এমনটাই মনে করছেন নেটিজেনরা। ডাঃ শফিকুর রহমানের মন্তব্যে জামায়ত সমর্থকদের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় সাংবাদিক আহমেদ আফগানী লিখেছেন, ‘নাম আমর ইবনে হিশাম। জ্ঞানী লোক, সম্ভ্রান্ত লোক, নেতৃত্ব স্থানীয় লোক। তার অনুসারীরা তাকে ডাকতো ‘আবুল হাকাম’ (জ্ঞানীর পিতা) বলে। এখন যেরকম ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘মানবতার আম্মা’ বলে। আল্লাহর রাসূল সা. সেই শীর্ষ জালিমকে গালি দিয়ে ডেকেছেন ‘আবু জাহেল’ (মূর্খের পিতা)। আবু জাহেল খুন করেছে বড় জোর ২০টা। তাতেই কিয়ামত পর্যন্ত ওকে আমরা গালি দিয়েই যাচ্ছি আবু জাহেল বলে। অথচ পাঁচ পাঁচটি গণহত্যা, হাজার হাজার মানুষের খুনীকে ফ্যাসিস্ট বলবো না? জালিমের জন্য মায়া কেন? কেন জালিমদের পরিবারের সদস্য বলতে হয়?’
কবি কাইয়ুম আব্দুল্লাহ লিখেছেন, ‘স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্টদের কাছে উদারতার কোনো মূল্য নেই। বরং উদারতার সুযোগে তারা সুদে আসলে তুলে নেবে।’ সাংবাদিক নূরুন্নবী লিখেছেন, ‘জামাতের উচিত ফ্যসিবাদ-বিরোধী কাউকে তাদের আমির বানানো।’
সজিব রহমান নামে একজন লিখেছেন, ‘ওনারা এতোদিন আওয়ামী জুলুমের কথা বলে সিম্পেথি অর্জনের রাজনীতি করেছেন, এখন শুধুমাত্র ভোটের আশায় আওয়ামী লীগকে নিয়ে সফটলি কথা বলছেন! আল্লাহ মাফ করুক।’
নাজমুল ইসলাম লিটন নামে একজন লিখেছেন, ‘ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন ফ্যাসিস্ট কে বারবার ফ্যাসিস্ট বলা উনি পছন্দ করেন না, উনি আরোও বলেছেন তারা নাকি উনার পরিবারের সদস্য। তারমানে উনার বাসুর, বুঝলাম বাসুরের নাম মুখে নিতে উনার লজ্জা লাগে। আমি জানিনা এই বক্তব্য জামাতের আমিরের ব্যাক্তিগত না দলীয়। উনি চাইলেই ফ্যাসিস্টকে ক্ষমা করতে পারেন? আমিতো বলবো দলগতভাবে জামাতেরও সেই এখতিয়ার নাই। বিগত ফ্যাসিজমের আমলে হাজার হাজার সাধারন নিরিহ মানুষকে জামাত-শিবির ট্যাগ দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। উনি ক্ষমা করলে নির্যাতিত মানুষগুলোর দায়ভার উনি নিবে না উনার দল নিবে?আসলে রাজনীতি খুব নোংরা জিনিস। ক্ষমতার জন্য সাদা পাঞ্জাবিওয়ালারা পতিতাবৃত্তিকে জায়েজ বলতেও দ্বিধা করেনা!’
মোঃ মিজান নামে একজন লিখেছেন, ‘যে বা যারা শত্রুকে বারবার শত্রু বলতে অমঙ্গল মনে করেন, তাহলে আপনারা মঙ্গলগ্রহে চলে যান। কারণ ফেরাউনের মতো শত্রু কখনোই ভালোবাসা, উদরতা ইত্যাদি প্রাপ্য নন,বরং একজন মোমেন ব্যক্তি ভালোবাসা, উদারতা প্রাপ্য। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আমরা সবাই এক ও অভিন্ন। তার সাথে নম্রতা, ভদ্রতা, উদারতা, ভালোবাসা দেখানো মানে জুলাইয়ের বিপ্লবীগনের রক্তের সাথে বেঈমানি ছাড়া আর কিছুই না। এখনো পর্যন্ত আমার ভাইয়ের রক্তের দাগ শুকাইনি, এখনো পর্যন্ত মায়ের আহাজারি শেষ হয়নি, এখনো পর্যন্ত স্বৈরশাসকের দাঙ্গা হাঙ্গামা শেষ হয়নি, তাদের সাথে কিসের উদারতা, ভালোবাসা! শুধু তাই নয়, এই স্বৈরশাসক হাজারো উলামায়েকেরামকে মাসকে মাস, বছরকে বছর, অন্যায়ভাবে কয়েদখানায় বন্ধি রেখেছে, ফাঁসির রশিতে লটকানো হয়েছে। তবুও যদি এই স্বৈরশাসকের অতীতের দেওয়া কষ্টগুলো এতো তাড়াতাড়ি ভুলে যায়, তাহলে বোকা ছাড়া আর কিচ্ছু না।’
আদিল হাসান নামে একজন লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগের আমলে সবচেয়ে বেশি নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়েছে জামাত। দলটির শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। অসংখ্য নেতা কর্মীকে গুম খুন করা হয়েছে। এই জামাতের মুখে আওয়ামী প্রেম মানায় না। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসলে জামাতকে আবারো আগের চেয়ে কঠিন ভাবে নির্মূল করবে- এ কথাটা মনে রাইখেন। একটা কথা আছে, কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না।’
শামসুল হুদা মাসুম নামে একজন লিখেছেন, ‘বারবার ফ্যাসিস্ট বলা পছন্দ করেন না, ওটা আপনার সমস্যা। কিন্তু রাজাকারদের রাজাকার, ফ্যাসিস্টদের ফ্যাসিস্টই বলা হবে। ইতিহাস যতদিন মুছে না যায়, ততদিন। যত বলা লাগবে, ততবার।’
সাংবাদিক খামিনি ইহ্সান লিখেছেন, ‘আবু সায়িদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোনো অন্যায় হতে দেখলে যেন হাত দিয়ে তা প্রতিহত করে। যদি তা না পারে, তবে কথা দিয়ে; তাও না পারলে অন্তর দিয়ে (ঘৃণা করবে)। এটি ঈমানের দুর্বলতম স্তর (মুসলিম : ৭৪)।’ কাজেই ফ্যাসিস্টদের ফ্যাসিস্ট বলে কিছুটা হলেও ঈমানের দাবি পূরণ করুন। ফ্যাসিস্টদের আত্মীয় স্বজন বলে তাদের প্রতি প্রেম পীরিতি দেখিয়ে দুর্বল ঈমানটুকুও হারাবেন না। মনে রাখবেন নেতারা সকাল বিকাল বদলাতে পারে৷ তবে আমাদের মিয়ারে হক বা সত্যের মাপকাঠিতো শুধুই রাসূল (সা.)।’
ইফতেখার হোসেন নামে একজন লিখেছেন, ‘জামায়াতে ইসলামী আমীর এর মিডিয়ায় কথা কম বলা উচিত। সবার সামনে কথা বলতে আরও সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। দীর্ঘ সময় এভাবে কথা বলতে, মিডিয়া ফেস করতে অভ্যস্ত না হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বের বক্তব্য অগোছালো অসম্পূর্ণ আর বেফাস কথা বের হয়ে যাচ্ছে। সেটা ঢাকতে আরও কতো কথা বলতে হচ্ছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের একজন সমর্থক সুরমা’কে বলেছেন, ‘জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের বক্তব্য দেখে অনেকে অবাক হইছেন, কারণ তিনি লীগরে ফ্যাসিস্ট বলতে চান না ও লীগরে নিজেদের ফ্যামিলির লোকই ভাবেন। শফিকুর রহমান মিথ্যা বলেন নাই। বড় রাজনীতিবিদদের নিজেদের মধ্যে কমবেশি একটা সমঝোতা থাকে। অভ্যুত্থানের পরে মির্জা ফখরুলের একটা স্বাক্ষাতকারে দেখা গেছিল তিনি বলতেছেন, তারে জেলে নেয়া হইলেও কখনো অসম্মান করা হয় নাই। তাদের জন্য “আলাদা” ব্যবস্থা ছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ভিক্টিম আমাদের মত ফুট সোলজাররা। এরাই বেশি আবেগী ও বেশি আদর্শবাদী হয়। মির্জা ফখরুল আর শফিকুর রহমানের মত বড় রাজনীতিবিদেরা বড় প্রেক্ষাপটে দেখেন, ফলে তাদের কাছে আমরা ফুট সোলজাররা টুল মাত্র। তাদের কাছে আমাদের রক্তের কোন মূল্য নাই।’
উল্লেখ্য, এর আগেও আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দেয়ার কথা বলে দেশের মানুষের তোপের মুখে পড়েছিলেন জামায়াত আমির ডা: শফিকুর রহমান। পরে তিনি তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করেছিলেন। কোন অবস্থাতেই আওয়ামী প্রেম দেখানোর সুযোগ নেই মন্তব্য করে দেশের মানুষ ভবিষ্যতে জামায়াত আমিরকে এই ধরনের বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
Share this content:
Post Comment