আইন ভঙ্গ করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছিলো মঞ্জুরি কমিশন
ঢাকা, ১৫ আগস্ট- কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে হঠাৎ সারা দেশে সব বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। একই সঙ্গে সব শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল ছাড়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এতে চরম বিপাকে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। মেয়ে শিক্ষার্থীদের অনিরপত্তার মধ্য দিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। ফেরার পথে শিক্ষার্থীরা অনেক জায়গায় হামলার শিকার হন।
তবে ইউজিসির আইন ভঙ্গ করে এই নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। এর নেপথ্যে ছিল ইউজিসির সচিব ফেরদৌস জামান ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেনসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। শিক্ষার্থীদের এই বিপদে ফেলানোর জন্য ওই সময়ের দায়ীদের শাস্তি চেয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।
জানা যায়, গত ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এদিন সহিংসতায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে ছয় জনের মৃত্যু হয়। পরিস্থিতি সামলাতে কয়েকটি শহরে বিজিবি মোতায়েন।
এদিন মধ্যরাতে হঠাৎ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তদারিক প্রতিষ্ঠান মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ইউজিসির সচিব ফেরদৌস জামানের সই করা নির্দেশনা বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে আবাসিক হল ত্যাগ করতে হবে। এরপরই সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনিরাপদ হয়ে পড়েন। যদিও সম্প্রতি বির্তকির্ত কর্মকান্ডে কর্মকর্তাদের তোপের মুখে সচিব ফেরদৌস জামানকে সচিব পদ থেকে বদলি করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সদ্য সাবেক সচিব ফেরদৌস জামান গণমাধ্যমকে বলেন, কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধের ঘোষণা করেছি। এ বিষয়ে কোনো লিখিত নির্দেশ দেওয়া হয়নি। মৌখিক নির্দেশনা অনুযায়ী এই ঘোষণা করা হয় বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেন, সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর নওফেলের নির্দেশক্রমে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধ ঘোষণা করেছি। ইউজিসির আইনে এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করার নিয়ম আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনে নিয়ম না থাকলেও সরকারে নির্দেশনা পালন করার কথা রয়েছে। তাই এমন পরিস্থিতিতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছি।
ইউজিসির প্রশাসন শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, কমিশনের সচিব পদ থেকে সদ্য অপসারিত ফেরদৌস জামান ও চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন কর্মকর্তা অতি উৎসাহী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেন। কোটা আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নিজ উদ্যোগ যোগাযোগ করেন ইউজিসির সচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জহুরুল হক হলের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফেরদৌস জামান। এরপর কমিশনের চলতি দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন পরিচালক মিলে চিঠি ইস্যু করে দেন। তবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হলে কমিশনের অন্যান্য সদস্য জানাতে হয়। সেটি করা হয়নি।
তাড়াহুড়া করে ১৬ জুলাই মধ্যরাতে প্রথমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেন ইউজিসি। একটু পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্থলে বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনা কথা জানানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ কেন করা হল, কোন আইনে করা হল কোন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
এদিকে ইউজিসি সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে সমালোচনা ঝড় উঠে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এর প্রতিবাদ করেন। তারা বলেন- প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব আইনে চলে। কোন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ফোরাম সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এছাড়া ১৯৭৩ সালে বিশেষ অধ্যাদেশে দেশের প্রথম চারটি ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব আইনে পরিচালিত হয়। স্বাধীনতা পরপরই ১৯৭২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক বরাদ্দ এবং বিষয় অনুমোদনের ক্ষমতা দেওয়া হয়। বর্তমানে দেশে ১১৫টি বেসরকারি ও ৫৮টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয় অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ের সিদ্ধান্ত অন্য কারো নেওয়ার এখতিয়ার নেই। তারপরও ইউজিসি আগ বাড়িয়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মত এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ ঘোষণা করেছে। এটা ইউজিসি করতে পারে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক গণমাধ্যমকে বলেন, স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধের সিদ্ধান্ত ইউজিসি নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
Share this content:
Post Comment