ওয়াক্‌ফ আইন বাতিলের দাবিতে পশ্চিমবঙ্গজুড়ে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ

  • পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিভাজন হতে দেব না: মমতা
  • হিন্দু বোর্ডে মুসলিম নেই, ওয়াকফ বোর্ডে হিন্দু কেন: সুপ্রিম কোর্ট

পশ্চিমবঙ্গ প্রতিনিধি: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে শুক্রবারও ওয়াক্‌ফ (সংধোধনী) আইন বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ ও জাতীয় সড়ক অবরোধসহ পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা দাবি তুলেছেন এই আইন অবিলম্বে বাতিল করার। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ছাড়াও মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর, হুগলির চাপদানি, মুর্শিদাবাদের লালগোলাসহ কলকাতার পার্ক সার্কাস, আমতলায় বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। পার্ক সার্কাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করেছেন কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা।

ওয়াক্ফ সংশোধনী আইন বাতিলের দাবিতে পশ্চিমবঙ্গে যখন উত্তাপ ছড়িয়েছে, সেই সময় রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে নিজের কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের বন্ধন দৃঢ় এবং সুদীর্ঘ দিনের।’ বুধবার কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে রাজ্যের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের এক সভা ডাকা হয়। সেই সভায় বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিরা যোগ দেন। সেখানেই মমতা এ কথা বলেন। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর দিকে আঙুল তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘এই সম্প্রীতিকে ওরা ভাঙতে পারবে না।’

শাসকদল বিজেপির উদ্দেশে মমতা বলেন, ‘ওরা মেরুকরণ করে বাংলার ক্ষমতায় আসতে চায়। তাই বিজেপির প্ররোচনায় কান দেবেন না। বিজেপির জনবিরোধি আইন আমরা সংবিধান সংশোধন করে পাল্টে দেব। অপেক্ষা করুন। আগামী এক বছর ধৈর্য ধরতে হবে। এরপর অনেক পরিবর্তন হবে দিল্লিতে। আবার নতুন সরকার হবে। যেদিন বিজেপি ক্ষমতা থেকে চলে যাবে, যে আইন জনবিরোধী করেছে, সেই আইন বদলাতে হবে। যদি সংকট সৃষ্টি হয়, আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে।’

মুর্শিদাবাদের সহিংসতা প্রসঙ্গে আজ মমতা বলেন, ‘বিজেপি কেন বাইরে থেকে লোক এনে এখানে গন্ডগোল পাকাবে? কেন এজেন্সির মাধ্যমে অশান্তি লাগাবে? আমি জেনেছি, বাচ্চা ছেলেদের হাতে ৫–৬ হাজার টাকা দিয়ে ইট ছোড়া হয়েছে। সীমান্ত দিয়ে কাদের ঢোকানো হয়েছে, তা খতিয়ে দেখব। আইন বাতিলের দাবি তুলুন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দরবারে। আমরা যুগ যুগ ধরে এই রাজ্যের মানুষকে একসঙ্গে রেখেছি। আমাদের ওপর ভরসা রাখুন, এই রাজ্যে আমরা হিন্দু–মুসলমান একসঙ্গে থেকেছি, একসঙ্গে থাকব, আমাদের সম্প্রীতির এই মিলন–বন্ধন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, চলবে। বিজেপি ফাটল ধরাতে পারবে না।’

মমতা মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করার আরজি জানিয়ে বলেন, ‘প্রয়োজনে রাস্তায় না করে বদ্ধ জায়গায় প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করুন। প্রয়োজনে দিল্লিতে গিয়ে প্রতিবাদ করা হোক। আজ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার আর অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু মুখ বন্ধ করে আছেন। পরিকল্পনা করে দাঙ্গা করানো হয়েছে। আর এর জন্য পুরোটা দায়ী কেন্দ্রীয় সরকার। আমরা এই বাংলাকে রক্তাক্ত করতে দেব না। এখন দেশের সব এজেন্সি তো অমিত শাহর হাতে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এখন এজেন্সি নিয়ে রাজনীতি করছেন।’

এদিকে সদ্য পাস হওয়া ওয়াকফ সংশোধনী আইনকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা অনেকগুলো মামলার একত্রিত শুনানিতে ইন্ডিয়ার শীর্ষ আদালত বুধবার (১৬ এপ্রিল) কেন্দ্রের উদ্দেশে একাধিক অস্বস্তিকর ও কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। বিশেষ করে নতুন আইনে সেন্ট্রাল ওয়াকফ কাউন্সিলে অমুসলিমদের সদস্য করার যে বিধান রাখা হয়েছে, সেই পটভূমিতে সুপ্রিম কোর্ট সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে হিন্দু এনডাওমেন্ট বোর্ডে (মন্দির বা দেবোত্তর সম্পত্তির পরিচালনা করে যারা) মুসলিম সদস্যদের রাখা হবে কি না? পাশাপাশি ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে ধরনের সহিংসতা দেখা যাচ্ছে, সেটাও বিচলিত করার মতো বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির প্রধান বিচারপতি।

সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের বেঞ্চ ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে মোট ৭৩টি পিটিশনকে একত্র করে করা শুনানিতে এই মন্তব্য করেন। এই বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি পিভি সঞ্জয় কুমার ও বিচারপতি কেভি বিশ্বনাথন। শুনানিতে ওয়াকফ বাই ইউজার বা বহুকাল ধরে ব্যবহারের দ্বারা মসজিদ বা কবরস্থানের মতো যে সম্পত্তি ওয়াকফ বলে চিহ্নিত, সরকার কীভাবে তার দখল নিতে পারে সে ব্যাপারেও সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ এদিনের শুনানির শেষে জানিয়েছেন, তারা একটি অন্তর্বর্তী রায় দেওয়ার কথা বিবেচনা করছেন যেখানে কয়েকটি বিষয় নিয়ে তারা মতামত দেবেন।

প্রথমত, যে সম্পত্তিগুলোকে আদালত ওয়াকফ বলে ঘোষণা করেছে, সেগুলোকে ডিনোটিফাই করা যাবে কি না, বা নন-ওয়াকফ হিসেবে ঘোষণা করা যাবে কি না। আর এটা ওয়াকফ বাই ইউজার বা সেরকম নয়, দুই ধরনের সম্পত্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। দ্বিতীয়ত, কালেক্টর (জেলা শাসক) এই ধরনের কেসে তার তদন্ত বা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু তার সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করা যাবে কি না। তৃতীয়ত, ওয়াকফ বোর্ড ও কাউন্সিলগুলোতে এক্স অফিশিও (পদাধিকারবলে) যারা নিযুক্ত হন তাদের কথা আলাদা (যেমন এমপি, এমএলএ, জেলাশাসক প্রভৃতি) কিন্তু বাদবাকি সদস্যদের মুসলিম হতেই হবে কি না।

তবে সুপ্রিম কোর্ট এগুলোর বিষয়ে এখনো কোনো রায় ঘোষণা করেনি। এ মামলার শুনানি চলবে। ইন্ডিয়ায় মুসলিম ওয়াকফ সম্পত্তি কীভাবে চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে, সেই সব আইনকানুনের আমূল পরিবর্তন করে লোকসভায় একটি বিতর্কিত বিল পাস হয় গত ৩ এপ্রিল। পরদিন বিলটি পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার অনুমোদন পায়। এরপর ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ওই বিলটিতে সম্মতি দেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ও গেজেট প্রকাশের পর তা আইনে পরিণত হয়।

Share this content:

Post Comment

অন্যান্য