সংবিধান সংস্কার ও নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন

  • ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ নয় ‘জনগণতন্ত্রী’ করার প্রস্তাব।
  • দলের প্রধান প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না, রাষ্ট্রপতি হবে নির্দলীয়।

আবদুল ওয়াহিদ তালিম, লণ্ডন: ১৫ জানুয়ারি, বুধবার, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন সংস্কার কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেন কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। পরে তিনি সাংবাদিকদের কাছে তাদের সুপারিশগুলোর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এতে ক্ষমতা কাঠামো, সংসদের ধরনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রস্তাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, দেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের মতো সুপারিশ রয়েছে।

রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির মধ্যে তিনটি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সেই সঙ্গে গণতন্ত্র বহাল রেখে রাষ্ট্র পরিচালনার নতুন আরও চারটি মূলনীতির সুপারিশ করেছে তারা। বর্তমানে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার যে চার মূলনীতি রয়েছে সেগুলো হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। বর্তমানের চার মূলনীতির মধ্যে শুধু গণতন্ত্র রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত নতুন পাঁচ মূলনীতির মধ্যে। সুপারিশ করা নতুন পাঁচটি মূলনীতি হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র। আর তিন মূলনীতি বাদ দেওয়ার বিষয়ে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশন সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং এ সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদগুলো বাদ দেওয়ার সুপারিশ করছে।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের যে জনআকাঙ্ক্ষা, তার প্রতিফলন হিসেবে আমরা রাষ্ট্রের পাঁচটি মূলনীতি সুপারিশ করছি। সেগুলো হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র। বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ সুপারিশ প্রতিবেদন করার কথা তুলে ধরেন সংস্কার কমিশনের প্রধান।

তিনি  বলেন, বাংলাদেশকে যেভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বলা হয়, তার মধ্যে আসলে যে প্রজাতন্ত্রের কথা হয়, সেটায় আমরা দ্বিমত পোষণ করেছি। আমরা বলেছি, বাংলাদেশের পরিচিত হওয়া উচিত ‘জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ প্রস্তুত করতে গিয়ে প্রায় এক লাখ মানুষের মতামত নেওয়ার কথা জানান আলী রীয়াজ। কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি ৩২ জন গবেষক এতে কাজ করেছেন।

সুপারিশগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক ঐক্যের আশা করে তিনি বলেন, একটা ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্নের ধারাবাহিকতায় আজকে আসলে কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা এই প্রস্তাবগুলো, সুপারিশগুলো রাখছি। আমরা আশা করছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এক ধরনের ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে।

একইভাবে ইসি সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বুধবার (১৫ জানুয়ারি) সকালে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর বিকেলে সংসদ ভবনে সংবাদ সম্মেলনে তাদের সুপারিশগুলোর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। কোনো দলের প্রধান প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না বলে প্রস্তাব করেছে নির্বাচন সংস্কার কমিশন।

বদিউল আলম মজুমদার জানান, ১৬টি ক্ষেত্র প্রায় ১৫০টি সুপারিশ দেওয়া হয়েছে।  ‘ভাঙা’ নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে অন্তর্ভূক্তিমূলক করার পাশাপাশি সব অংশীজনকে দায়বদ্ধতার মধ্যে আনার লক্ষ্যে এই সুপারিশগুলো করা হয়েছে।

উল্লেখযোগ্য সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে— কোনো ব্যক্তি দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না। কোনো দলের প্রধান প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার দিতে হবে। রাষ্ট্রপতি হবে নির্দলীয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচন দেওয়া। ২০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হবে। দুইবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কেউ রাষ্ট্রপতি না হন। একই সঙ্গে কেউ যেন প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা এবং দলীয় প্রধান পদে থাকতে পারবে না।  সংসদের উচ্চকক্ষ হবে সংখ্যানুপাতিক ভিত্তিতে।  উচ্চকক্ষের অর্ধেক সদস্য হবেন দলীয়, বাকি অর্ধেক হবেন নির্দলীয়। নির্দলীয় সদস্যদেরও রাজনৈতিক দলগুলোই মনোনয়ন দেবে। কিন্তু সেখানে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণ হবে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে। সংসদের আসন ১০০টি বাড়ানো। এরমধ্যে এক চতুর্থাংশ নারীদের জন্য সংরক্ষিত করা এবং এগুলো ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নির্বাচন করা। যার মাধ্যমে নারীরা সরাসরি নির্বাচিত হবেন।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একাধিক আসনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ বাদ, কোনো আসনে ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে ওই আসনের ভোট বাতিল এবং কোনো আসনে ‘না’ ভোট বেশি পড়লে সেই আসনে নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের সুপারিশ করেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।

এছাড়া রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিক কোনো সংগঠন না রাখার সুপারিশ করেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। কমিশন বলেছে, রাজনৈতিক দলের ছাত্র, শিক্ষক ও শ্রমিক সংগঠন, ভ্রাতৃপ্রতিম বা যেকোনো নামেই হোক না কেন, না থাকার বিধান করা যেতে পারে।

এ দিন আরও দুটি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। বাকি দুটি কমিশন হলো দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন।

উল্লেখ্য, গত আগস্টে দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্তর্বর্তী সরকার দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে এবং জনমালিকানা, জবাবদিহিতা ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য কমপক্ষে ১৫টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। সংবিধান, নির্বাচনী ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন এবং দুদকের সংস্কারের জন্য প্রথম ছয়টি কমিশন ৩ অক্টোবর গঠিত হয়। তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সময়সীমা ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এবং বাকি পাঁচটি কমিশনের সময়সীমা ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

Share this content:

Post Comment

অন্যান্য