বাজার ও পরিবহনে চাঁদাবাজি চলছেই

ঢাকা অফিস, ১২ অক্টোবর- ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতন ঘটলেও বাজার ও পরিবহনে এখনো চাঁদাবাজি চলছেই। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের ধাক্কায় কেবল চেহারায় বদল ঘটেছে, চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি, চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য কমেনি। সরকার বদলের শুরুর দিকে কিছুটা ‘বিরতি’র পর চাঁদাবাজির হাতবদল হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জেলফেরত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। তাদের শিষ্যরা দলেবলে মাঠে নেমে পড়েছে চাঁদাবাজিতে। এ অবস্থায় আগের মতোই নীরবে-সরবে চলছে চাঁদাবাজির মহোৎসব।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভুক্তভোগীরা সেই আগের মতোই চুপচাপ চাঁদা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রাণভয়ে কারও কাছে কোনো অভিযোগও করতে পারছেন না। তাদের অভিযোগ, চাঁদা বন্ধ নেই। পুরনো গ্রুপ পালিয়েছে। নতুন গ্রুপ পুরনোদের জায়গায় এসে চাঁদা তুলছে।

শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বের হয়েই ডিস-ইন্টারনেট ব্যবসা, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন, ফুটপাত, বাজার, ঝুটব্যবসা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও নির্মাণকাজ থেকে চাঁদাবাজি এবং জমি দখলের মতো বিভিন্ন খাত থেকে চাঁদা তোলা ও আর্থিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছেন। তারা কখনো ফোনে আবার কখনো সরাসরি এসেও চাঁদা নিয়ে যাচ্ছে। জানা যায়, চাঁদাবাজদের সবচেয়ে বড় টার্গেট পয়েন্ট হচ্ছে শিল্পাঞ্চল, বাণিজ্যিক এলাকা, বাস, নৌ-টার্মিনাল ও হাটবাজার। এই চাঁদাবাজদের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সব সময়ই ক্ষমতাসীন দলের অনুগত হয়ে আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যবসায়ী আর বাসিন্দারা অতিষ্ঠ ছিলেন এই চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের অত্যাচারে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সেই সরকারের পতনের পর নির্যাতিতরা ভেবেছিল তাদের ভাগ্যে বোধ হয় পরিবর্তন আসবে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটা ঘটেনি। বিগত সরকারের আমলের চাঁদাবাজদের ছেড়ে যাওয়া শূন্য আসন পূর্ণ হয়ে গেছে খুব দ্রুতই। সব পয়েন্টেই আবার নতুন করে শুরু হয়েছে দখল ও চাঁদাবাজি। আর এই চাঁদাবাজরাও বর্তমান সময়ে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কিছু অসাধু নেতার আশীর্বাদপুষ্ট। তবে পুলিশের চাঁদাবাজি নিয়ে আপাতত তেমন অভিযোগ মিলছে না।

রাজধানীতে চাঁদাবাজদের সবচেয়ে বড় রাজত্ব সায়েদাবাদ, মহাখালী, গাবতলী আর ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড বা টার্মিনাল। আগে এসব এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করত ‘শাহজাহান-রাঙা, এনায়েত-সিরাজ, কালাম-রুস্তম-সামদানি’ সিন্ডিকেট। তারা সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরিবহন নেতা নামধারী এই চাঁদাবাজরা এখন সবাই পলাতক। কিন্তু তাতে থেমে নেই ওইসব পয়েন্টের চাঁদাবাজি। এসেছে নতুন মুখ। পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি বহাল তবিয়তেই রয়েছে। পুরনোর শূন্যস্থানে এখন সক্রিয় রয়েছে ‘নতুন মুখের’ চাঁদাবাজি। চাঁদাবাজদের আরেকটি বড় টার্গেট পয়েন্ট রাজধানীর কারওয়ান বাজার। আগে কারওয়ান বাজারের পুরো চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের লোকজন। লোকমান এবং তার অনুগত সন্ত্রাসীরা এই চাঁদাবাজির টাকা তুলতেন। সরকার পরিবর্তনের পর গা ঢাকা দিয়েছে এই চক্র। এসেছে আরেক গ্রুপ। দখল ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে গত ৯ সেপ্টেম্বর রাতে সংঘর্ষ হয় কারওয়ান বাজারে। এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা ওই সংঘর্ষের সময় অনেকের হাতেই দেশীয় অস্ত্র দেখা গেছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, রাত ১১টার দিকে কারওয়ান বাজারে ব্যবসায়ীদের থেকে চাঁদা নেওয়ার জন্য আসেন শ্রমিক দল নেতা জালাল আহমেদের নেতৃত্বে শতাধিক চাঁদাবাজ। ব্যবসায়ীরা শিক্ষার্থীদের খবর দিলে তারা এসে চাঁদাবাজদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। এ সময় চাঁদাবাজদের হামলায় শিক্ষার্থীসহ একাধিক ব্যবসায়ী আহত হন। পরে শিক্ষার্থীরা জালাল আহমেদকে আটক করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেন। কিন্তু চাঁদাবাজদের মধ্যে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। এমন পরিস্থিতি এখন সর্বত্র। রাজধানীর আজিমপুর লালবাগে নতুন করে মাথা চাড়া দিয়েছে মোহাম্মদ হোসাইন, রানা, ছোট বাপ্পিসহ অন্তত ৪০ জনের চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট কাজ করছে। চাঁদাবাজির সঙ্গে এরা এলাকায় চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী।

এদিকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজির সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় বিএনপি এবং দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন অভিযোগে অনেকের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। কেউ যাতে এই অপকর্মে জড়িত না হয় তার জন্য বারবার সতর্ক করা হচ্ছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাম্প্রতিককালে তার একাধিক বক্তব্যে চাঁদাবাজি ও দখলদারত্ব থেকে দলের নেতা-কর্মীদের বিরত থাকতে বারবার আহ্বান জানিয়েছেন। কেউ এসব অপকর্মে জড়িত হলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও সতর্ক করেছেন তিনি।

Share this content:

Post Comment

অন্যান্য