ছাত্র-জনতার নতুন শ্লোগান ‘আবু সাঈদ-মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’
- আদালত প্রাঙ্গণে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ।
- বেঞ্চ পাবেন না হাইকোর্টের ১২ বিচারপতি।
মিনহাজুল আলম মামুন, ১৬ অক্টোবর: মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী লে. কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত মুহাম্মদ ফারুক খান এবং ড. আব্দুর রাজ্জাকের রিমান্ড আবেদন শুনানির সময় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সামনে ‘শেখ হাসিনা সরকার, বার বার দরকার’, ‘শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’ শ্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন আওয়ামী লীগের আইনজীবীরা। তারই জবাবে ও আওয়ামীপন্থি বিচারকদের পদত্যাগের দাবিতে হাইকোর্ট ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা। বেলা ১১টায় রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হয়ে সেখান থেকে ‘আবু সাঈদ-মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’ শ্লোগান দিয়ে ছাত্র-জনতা একসঙ্গে হাইকোর্ট অভিমুখে যাত্রা শুরু করে।
এর আগে আওয়ামীপন্থি বিচারকদের পদত্যাগের দাবিতে হাইকোর্ট ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম। মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, নিজেদের ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে এক পোস্টে এ কর্মসূচির ডাক দেন তারা। পোস্টে তারা লিখেন, ‘আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট বিচারকদের পদত্যাগের দাবিতে আগামীকাল সকাল ১২টায় হাইকোর্ট ঘেরাও কর্মসূচি।’ কমেন্ট সেকশনে হাসনাত লিখেন, ‘যে লীগের হাতে হাজার হাজার ছাত্র ও নাগরিকের রক্ত লেগে আছে, দুই মাস না যেতেই তাদের কীভাবে দুঃসাহস হয় হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে খুনি হাসিনার নামে স্লোগান দেওয়ার?’ কমেন্ট সেকশনে সারজিস আলম লিখেন, ‘এই খুনি হাসিনার দালালদের কারণেই রাষ্ট্র ঠিকমতো ফাংশন করতে পারছে না ৷ এদের উৎখাত না করা পর্যন্ত দেশ সামনে এগোতে পারে না, পারবে না ৷’
আদালত প্রাঙ্গণে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ
পুর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সকাল থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হতে থাকেন। সর্বোচ্চ আদালতের নিরাপত্তায় আগে থেকেই সুপ্রিম কোর্টের প্রতিটি ফটকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি ছিল। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরাও সুপ্রিম কোর্টের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করছিলেন। জমায়েত বাড়লে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমের নেতৃত্বে দুপুর ১২টার দিকে মিছিল করতে করতে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এসে অ্যানেক্স ভবনের সামনে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। চলতে থাকে মিছিল-স্লোগান। সেখান থেকে ‘দলবাজ, দুর্নীতিবাজ ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দোসর’ বিচারকদের পদত্যাগ বা অপসারণের আলটিমেটাম দেন। এরপর বিকেল ৩টার দিকে রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমেদ ভূঞার সঙ্গে বৈঠকে বসেন সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম, আরিফ সোহেলসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিরা। এর কিছুক্ষণ পর সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে অবস্থান নেওয়া আন্দোলনকারীদের মাঝে এসে ঘোষণা দেন রেজিস্ট্রার জেনারেল।
হাইকোর্টের ১২ বিচারককে বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার তাঁর ঘোষণায় বলেন, ‘আমি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল হিসেবে আপনাদের যে দাবি, তা নিয়ে আপনাদের যে লিডার তাঁরা আমার চেম্বারে বসেছেন। অনেক্ষণ আলোচনা করেছি। পরবর্তী পর্যায়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। সঙ্গে আমার দুজন সহকর্মীও ছিলেন। আপনারা জানেন, বিচারপতির (সুপ্রিম কোর্টের) পদত্যাগ বা অপসারণের একটা প্রক্রিয়া আছে। বর্তমানে দেশে এসংক্রান্ত কোনো আইন বিদ্যমান নেই। বিগত সরকার সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট সেটি (সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মামলার মাধ্যমে) বাতিল করে দিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে সরকার (বিগত আওয়ামী লীগ সরকার) আবার রিভিউ করেছে। আগামী রবিবার ২০ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে মাননীয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে আপিল বিভাগে এই রিভিউ আবেদনের শুনানি হবে। ওই দিন এটিকে এক নম্বর আইটেম হিসেবে রাখা হয়েছে।’
আজিজ আহমেদ ভূঞা বলেন, ‘বিচারপতিদের নিয়োগকর্তা হচ্ছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। পদত্যাগ বা অপসারণ সে উদ্যোগও মহামান্য রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে হয়ে থাকে। এখানে মাননীয় প্রধান বিচারপতির যেটা করণীয় উনি সেটা করেছেন। আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, আপাতত ১২ জন বিচারপতিকে প্রাথমিকভাবে কোনো বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না। বেঞ্চ না দেওয়ার অর্থই হলো আগামী ২০ অক্টোবর যে কোর্ট খুলবে (অবকাশ ছুটির পর) তখন তাঁরা (১২ জন বিচারক) আর বিচারকাজে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। আর ওই (ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউ) মামলার শুনানি আছে ২০ অক্টোবর। মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেল সেটি উপস্থাপন করবেন বলে আশা করছি। এর মাধ্যমে পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো শুরু হবে। আপাতত ১২ জন বিচারপতিকে বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না। পর্যায়ক্রমে শুনানির মাধ্যমে বাকিগুলো আপনাদের সামনে আসবে।’
রেজিস্ট্রার জেনারেলের ঘোষণার পর সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও আরিফ সোহেল বক্তব্য দেন। হাসনাত আবদুল্লাহ তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘বিচারপতি অপসরাণের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মামলাটি চলমান আছে। আগামী ২০ তারিখ ওই মামলায় যদি সমাধান চলে আসে, তাহলে বিচারপতি অপসারণের দায়িত্ব হচ্ছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের। তাহলে সেদিনই আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সঙ্গে জড়িত বিচারকদের পদত্যাগ করতে হবে। তাঁদের অপসারণ করা হবে। তারা (সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন) আমাদের কথা দিয়েছে। ফলে রবিবার বিকেল পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব। তাঁদের অপসারণের কী রায় আসে, আমরা তা পর্যবেক্ষণ করব। তারপর আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ। রবিবার (২০ অক্টোবর) যদি প্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত না আসে, তাহলে সোমবার থেকে পুরো বাংলাদেশ দেখবে।
সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমরা দেখেছি হাইকোর্ট, জজকোর্টসহ আমাদের যতগুলো বিচারালয় আছে, সেখানে দম্ভের সঙ্গে তাঁরা (আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা) শেখ হাসিনার পুনর্বাসনের জন্য মিছিল বের করেছেন। তাঁদের (আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের) অপসারণে সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের কোনো এখতিয়ার নেই। আমরা ছাত্র-নাগরিকের পক্ষ থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে দাবি জানাচ্ছি, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের গ্রেপ্তার করবেন।’
যে ১২ বিচারককে বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ১২ বিচারককে বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। একই সঙ্গে আগামী ২০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণসংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউ (পুনর্বিবেচনার আবেদন) শুনানির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ হাইকোর্টের যে ১২ বিচারককে বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের একটি সূত্র থেকে সেই বিচারকদের নাম জানা গেছে। তাঁরা হলেন—বিচারপতি নাইমা হায়দার, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার, বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস, বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামান, বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান, বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিন, বিচারপতি মো. আক্তারুজ্জামান, বিচারপতি আতাউর রহমান খান, বিচারপতি খিজির হায়াত, বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলন।
Share this content:
Post Comment