ঢাকার পরিকল্পিত এক আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে ওঠে ধানমন্ডি। ছিল টলটলে পানির লেক, অবারিত খোলা মাঠ আর গাছপালায় ছাওয়া একতলা–দোতলা বাড়ি। সেই ধানমন্ডির কথা মনে করে স্মৃতিকাতর হলেন স্থাপত্য ইতিহাসবিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্থপতি ড. সাজিদ বিন দোজা।
।। জীবনযাপন ডেস্ক ।।
এখন শুনলে মনে হয় রূপকথা। ধানমন্ডির প্রতিটা প্লটে ছিল একটি করে সুন্দর একতলা বা দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে প্রশস্ত বাগান, নিচু সীমানাপ্রাচীর, লোহার বর্গাকার বুননের গেট। বসতের সামনে লগিয়া বা বারান্দা। সেখানে বেতের চেয়ার টেবিল পাতা। চারদিকে বিস্তর জায়গা। কাঁঠাল, নিম, বরইগাছের সন্নিবেশে বাড়িগুলো সত্যিই ছিল ছায়াঘেরা শান্তির নীড়। প্রতিবেশীদের মধ্যে ছিল নিবিড় সম্পর্ক।
যেভাবে ধানমন্ডি
ধানমন্ডির নামকরণ নিয়ে চালু আছে বেশ কয়েকটি গল্প। ইতিহাস বলছে, এ এলাকায় প্রচুর ধান উৎপাদিত হতো। ব্রিটিশ আমলে এখানে ধানের বড় বাজার বসত। ফারসি ভাষায় বাজারকে বলে ‘মন্ডি’, আর তাই ধানের বাজার থেকে এলাকাটির নাম হয়ে যায় ধানমন্ডি।
চল্লিশের দশকেও এখানে পুরোদমে কৃষিকাজ হতো। বাংলায় ‘মণ্ডন’ শব্দের অর্থ অলংকরণ বা সাজসজ্জা। সোনালি পাকা ধানে ছেয়ে থাকা মাঠগুলোকে মনে হতো এলাকাটির অলংকার। অনেকে মনে করেন, সেই ধানের মণ্ডন থেকেই এসেছে ‘ধানমন্ডি’। কারণ যাই হোক, বোঝাই যাচ্ছে ধানমন্ডির ইতিহাসের সঙ্গে ধানের সংযোগ গভীর ও অমোঘ।
এক শতাব্দী আগেও ধানমন্ডি ছিল উলুখাগড়া আর ছনগাছের রাজ্য। দিগন্তবিস্তৃত ধানখেত, ফাঁকা মাঠ আর জলাশয় ছিল এলাকাটির দৃশ্যপটের প্রধান উপাদান। কালেভদ্রে মানুষের দেখা মিলত। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ধানমন্ডি নামের এই প্রান্তিক গ্রামে মানুষজন বসবাস শুরু করে। ১৮৫৯ ও ১৯২৪ সালের ঢাকা শহরের মানচিত্রে ধানমন্ডির কাছে একটি জলাশয়ের উপস্থিতি স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়, যা বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে পড়েছে। এটি ছিল মূলত কারওয়ানবাজার নদীর একটি পরিত্যক্ত চ্যানেল। ওই নদী বা খালটি পরে শুকিয়ে যায়, তার সঙ্গে ধান-চালের বাজারটিও বিলুপ্ত হতে থাকে। একসময় খালটি হয়ে পড়ে শুকনা, বাকিটা জঙ্গলাকীর্ণ।
বসতির গোড়াপত্তন
ধানমন্ডিকে একটি আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৪৯ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেয় পূর্ব পাকিস্তান সরকার। এই লক্ষ্যে ১৯৫০ সালে কৃষি ও উদ্যান–সংশ্লিষ্ট ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করে কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড বিল্ডিং ডিপার্টমেন্ট। সেই জমি সমতল করে জনসাধারণের মধ্যে প্লট আকারে বরাদ্দ দেয় তারা। জনসাধারণের সুবিধার্থে পরে রাস্তা ও অন্যান্য ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করে ডিআইটি (ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট)।
১৯৬০-এর দশকে ধানমন্ডি যখন একটি আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে, জলাশয়টিকে তখন একটি লেকে রূপান্তর করা হয়। পুরো এলাকার ১৬ শতাংশ জমি লেকের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল।
এলাকাটিকে কয়েকটি ব্লকে বিভক্ত করা হয়। প্রতিটি ব্লককে এক বিঘা বা তার কম মাপের প্লটে ভাগ করা হয়। এই প্লটগুলো মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তা, জননেতা, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তৈরি হয় প্রশস্ত রাস্তা, খোলা স্থানে লাগানো হয় গাছপালা, এভাবে ধীরে ধীরে আরও মনোরম হয়ে ওঠে পরিবেশ। বিঘা প্রতি ৫ হাজার টাকা দিয়ে ৯৯ বছরের জন্য প্লট লিজ পান বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা।
উত্তর-দক্ষিণের প্রাচীন জলাশয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে একটি মহাপরিকল্পনার আওতায় ধানমন্ডির আবাসিক এলাকার গোড়াপত্তন। ওই পরিকল্পনায় সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে রাখা হয় সড়কের নকশাও। পূর্ব–পশ্চিমে মিরপুর রোড ও সাতমসজিদ রোডের উত্তর–দক্ষিণ বরাবর দুটি প্রধান সড়ক পুরোনো ২৭ নম্বর রোড ও ১ নম্বর রোডের অন্তর্বর্তী এলাকাটিই পরিচিতি পায় ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা হিসেবে। গড়পড়তায় এক বিঘার মতো করে জমি পান গ্রাহকেরা। সমান্তরাল রাস্তার মধ্যে প্লটগুলো বসানো। বসত নির্মাণের আগেই শেষ হয় রাস্তাগুলোর কাজ । তবে এখনকার মতো এতটা চওড়া ছিল না সেই রাস্তা, খুব বড়জোর ২০ ফুট, দুই পাশে ঘন ঘাসে ঘেরা। রাস্তাগুলো দক্ষিণ দিক থেকে ক্রমে উত্তর দিকে গিয়ে শেষ হয়েছে, যার শেষ রাস্তা হলো আজকের পুরোনো ২৭ নম্বর রোড। আধুনিক আবাসিক এই এলাকায় প্রাধান্য পায় খোলা পরিসর বা খেলার মাঠ। প্রবহমান লেকটি হয়ে ওঠে স্থানীয় জলবায়ুর আধার। কারণ, দক্ষিণ–পূর্ব থেকে প্রবাহিত হয়ে জলাশয়ের ওপর দিয়ে আসার সময় শীতল সমীকরণ হয়ে আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করত বাতাস।
একতলা–দোতলা
এক বিঘা অথবা ২০ কাঠা জমির ওপর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড বিল্ডিং ডিপার্টমেন্টের (পরে যা ডিআইটি হয়) অনুমোদন সাপেক্ষে নকশা পাস করা হতো। পঞ্চাশের দশকের শেষ মাথায় একতলা বসতই দেখা যেত বেশি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি আবাসনের ঘনত্ব বাড়তে থাকে। প্রয়োজনের তাগিদে এই সময়ে দোতলা বা তিনতলা দালান তৈরি হওয়া শুরু হলো। বেশির ভাগ আবাসন বাক্তিমালিকানায় নির্মিত হতো।
লগিয়া দিয়ে প্রবেশের পর বড় একটি স্পেস, যেখানে থাকত বিশাল ড্রয়িংরুম, লাগোয়া ডাইনিং হল। জানালার কারণে আলো–বাতাসও ছিল পর্যাপ্ত। এই দিকে একটি বেডরুম রাখা হতো, যা অতিথির ঘর হিসেবে পরিচিত ছিল। ডাইনিং হলের সঙ্গে একটি হ্যান্ডওয়াশের জায়গাও থাকত। দেয়ালটির পেছনে পাউডার রুমের উপস্থিতি নজরে আসত।
কখনো আবার ড্রয়িং ও ডাইনিংয়ের মাঝখানে আচ্ছাদিত ছাদসহ বড় একটি বারান্দা। সুন্দর লোহার গ্রিলে আপাদমস্তক নকশা করা থাকত। মশা থেকে রেহাই পেতে থাকত কাঠের পাতলা বিট দিয়ে ফ্রেম করা চিকন নেট। বসতটা একতলা হলে ডাইনিংয়ের সঙ্গে একটি করিডর চলে যেত সব কটি বেডরুমকে স্পর্শ করে। প্রথম ঘরটি হতো মাস্টার বেড, পরেরগুলোও একইভাবে করিডর লাগোয়া। সাধারণত তিন থেকে চারটি বেডরুম থাকত।
রান্নাঘরটি হতো বড়সড়, যা বাড়ির উত্তর-পশ্চিম পাশে রাখা হতো। পশ্চিমে আলোর উপস্থিতি থাকত প্রচুর। ছোট ডাউনওয়াশসহ রান্নাঘরের বাইরে আচ্ছাদিত একটি ফ্লোর থাকত, যা আউটডোর কিচেন হিসেবে কাজ করত। ছাদে যাওয়ার সিঁড়িটি করিডরের এক পাশে পশ্চিম দিকে নির্মিত হতো।
আর দোতলা বসতের সিঁড়িটা ড্রয়িংরুমের এক পাশে বিশেষ কায়দায় বানানো হতো। দোতলার বেডরুমগুলো বানানো হতো সিঁড়ির পাশে থেকে করিডর ধরে। ফ্যামিলি লিভিংয়ের জন্য দোতলার ঘরগুলোর মাঝখানে বা এক পাশে টেরাসসহ পরিবারের জমায়েতের একটি স্থান করা হতো। জায়গাটি বেশ বড় থাকত। এখানকার পাশের সিঁড়ি দিয়ে ছাদে চলে যাওয়া যেত। ছাদে ছোট্ট একটি চিলেকোঠা রাখা হতো, অনেক বাড়িতে এই ঘরেই চলত সৃজনশীল কাজ। কেউ কেউ অবশ্য পড়াশোনার জন্য রাখতেন এই ঘর। বিশাল ছাদের এক পাশে নুইয়ে পড়ত বরই অথবা কাঁঠালগাছ। ছাদেও বাগান করার চর্চা ছিল।
বসতের প্রতিটি তলার উচ্চতা ছিল আজকের দিনের বসত থেকে অনেক উঁচু। এতে জলবায়ুবান্ধব অবস্থার সৃষ্টি হতো। ভবনের অন্দর থাকত শীতল। লেকের পাশের বাড়িগুলোর অবস্থান ছিল জলাশয়মুখী। নিচু আকর্ষণীয় নকশার প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকত বসত।
আশির দশকে ধানমন্ডি
আশির দশকে ধানমন্ডির আবাসিক এলাকা ছিল ঢাকার অন্যতম অভিজাত ও শান্তিপূর্ণ অঞ্চল। এ সময় ধানমন্ডি ছিল মূলত ধনী ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির লোকদের বাসস্থান। আশির দশকের ধানমন্ডির প্রধান কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো—
চিরহরিৎ, নিরিবিলি, গোছানো ও চিত্রবৎ মায়াবী এক আবাসন ছিল ধানমন্ডি। আজও আমার চোখে ভাসে সত্তর–আশির দশকের সেই সুন্দর পরিপাটি ধানমন্ডি। মূলত নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই পরিবর্তিত হতে থাকে পটভূমি। ধীরে ধীরে ধানমন্ডিতে ঢুকে পড়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও ফ্ল্যাট–সংস্কৃতি। গড়ে উঠতে শুরু করে বহুমুখী চাহিদার ভবন। আসে জমির মালিকানায় পরিবর্তন, আবাসনপ্রতিষ্ঠানের হাতছানিতে হারিয়ে জেতে থাকে দোতলা, তিনতলা। গড়ে উঠতে শুরু করে নতুন ধারার স্থাপত্য। জনসংখ্যার চাপে বসতে যুক্ত হয় এলোপাতাড়ি অভিযোজন ও বহুমুখীকরণ। জীবাশ্মে পরিণত হয় ধানমন্ডির আদি দৃশ্যপট, কারও মনে, কারও ফটোগ্রাফে যা এখন শুধুই স্মৃতি হয়ে টিকে আছে।
(লেখাটি বর্ণিল বসত নভেম্বর ২০২৪–সংখ্যায় প্রকাশিত)