মিনহাজুল আলম মামুন, লণ্ডন: ব্যাপক চাপের মুখে ১৪ জানুয়ারি, মঙ্গলবার, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিটি মিনিস্টার হিসেবে পরিচিত (ইকোনমিক সেক্রেটারি) টিউলিপ সিদ্দিক পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশের পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘনিষ্ঠের থেকে ফ্ল্যাট উপহার নেওয়া, রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অভিযোগের মুখে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তিনি। লেবার পার্টির একটি সূত্র সুরমা’কে জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার টিউলিপকে পদত্যাগের পরামর্শ দিয়েছিলেন। পদত্যাগ না করলে তিনি সিটি মিনিস্টার পদ থেকে বহিস্কৃত হতেন। টিউলিপ পদত্যাগ করার পরপরই লেবার পার্টির এমপি এমা রেনল্ডসকে নতুন সিটি মিনিস্টার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর দলের ভেতরেই প্রবল চাপে পড়েন টিউলিপ সিদ্দিক। একপর্যায়ে বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টির প্রধান নেতা কেমি ব্যাডেনোচ তাকে বরখাস্তের আহ্বান জানান। কিন্তু কিয়ার স্টারমারের নীরবতা এবং প্রথম দিকে টিউলিপের পক্ষাবলম্বন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকেও চাপে ফেলে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনের ফলে পরিস্থিতি লেবার পার্টির ইমেজ রক্ষার দিকে গড়াতে থাকে। মন্ত্রিত্ব থেকে যে বরখাস্ত করা হতে পারে তা টিউলিপও ইঙ্গিত পেয়েছিলেন।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তাকে নিয়ে সমালোচনা চলছে। তবে তিনি পদত্যাগের পরও এই সমালোচনা শেষ হয়নি। ১৫ জানুয়ারি, বুধবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টে টিউলিপ সিদ্দিককে নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা হয়েছে। টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগ ঘিরে প্রশ্নের মুখে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। বিরোধীদলীয় নেতা বেইডনক বলেন, ‘নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর পদত্যাগে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) গভীর দুঃখ পেয়েছেন বলে গতকাল বলেছেন। তার এমন মন্তব্য আমাদের কী বার্তা দেয়? আর ঘটনাটি ছিল দুর্নীতি দমনের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এবং দুর্নীতির ফৌজদারি তদন্ত হচ্ছে।’
লেবার পার্টির সামনে সতর্ক সংকেত সবসময়ই ছিল। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও খালা শেখ হাসিনার সঙ্গে ২০১৫ সালে টিউলিপ সিদ্দিকের যে ছবি প্রকাশিত হয়েছিল, তা থেকেই সতর্ক হওয়া যেত। কিন্তু ওই ছবি লেবার পার্টির ভেতর উদ্বেগ সৃষ্টি করলেও সেটাকে গুরুত্ব দেয়নি দলে নীতিনির্ধারকরা। তাঁরা এখন আত্মগ্লানিতে ভুগছেন। বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে টিউলিপের সম্পর্ক ও সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হওয়ার পর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের কেউ কেউ এখন আফসোস করছেন। তাঁরা বলছেন, টিউলিপ সরকারের দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়ার আগে এর প্রভাব ও পরিণতি নিয়ে আরও চিন্তা করা উচিত ছিল। তাঁরা ভুল করে ফেলেছেন। লেবার পার্টির এক এমপিকে উদ্ধৃত করে দ্য গার্ডিয়ান বলেছে, ‘এটি ছিল একেবারেই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। সবাই জানত, তিনি বাংলাদেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য, যাদের ক্ষমতা এবং অর্থ-প্রতিপত্তির সঙ্গে গভীর সংযোগ আছে। কে আর ভেবেছিল যে, তাকে এ দায়িত্ব দেওয়ার পর এত ঝক্কি সামলাতে হবে!’
এদিকে টিউলিপের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর এ নিয়ে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নীতি উপদেষ্টা লাউরি ম্যাগনাস তদন্ত করেন। তিনি টিউলিপের বিরুদ্ধে নথিপত্রের ঘাটতি ও সময় স্বল্পতার কারণে অভিযোগ সম্পর্কিত সব তথ্য সংগ্রহে অপারগতার কথা উল্লেখ করেন। এ অবস্থায় টিউলিপের বিরুদ্ধে আরও তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন ব্রিটিশ ছায়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস ফিলিপ। ক্রিস ফিলিপ মনে করেন, সিটি মিনিস্টারের পদ থেকে সদ্য ইস্তফা দেওয়া টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে আরও তদন্ত হওয়া উচিত। এ বিষয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত ধীরগতিতে এগিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
কনজারভেটিভ পার্টির এই নেতা বলেন, টিউলিপের অত্যন্ত ব্যয়বহুল সম্পত্তির উৎস নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি বলে নীতি উপদেষ্টা উল্লেখ করেছেন। আমি গণমাধ্যমে দেখেছি, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে তা যুক্তরাজ্যে এসে পৌঁছেছে। এই পুরো বিষয় তদন্তের আওতায় আনা উচিত। যুক্তরাজ্যের জাতীয় অপরাধ সংস্থা এ বিষয়ে নজর দিতে পারে। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এসব সম্পত্তি কিনতে ব্যয় করা অর্থের উৎস তদন্ত করে প্রকৃত ‘চেইন অব ক্যাশ’ খুঁজে বের করা উচিত।
উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, টিউলিপ ও তাঁর পরিবার লন্ডনে আওয়ামী লীগের সদস্য বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কেনা পাঁচটি সম্পত্তি বিনামূল্যে পেয়েছেন বা ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প থেকে টিউলিপের পরিবার ৩৯০ কোটি পাউন্ড (৫৮ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা) পর্যন্ত অর্থ আত্মসাৎ করার যে অভিযোগ উঠেছে, সে-সংক্রান্ত তদন্তেI তাঁর নাম ওঠে এসেছে।