লন্ডনে বিএনপি-জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতার বৈঠক

- নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াতের হঠাৎ ইউটার্ন।
লন্ডন, ১৭ এপ্রিল: রোববার, ১৩ এপ্রিল লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাসায় গিয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ্ আবু তাহের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করে দেশে ফিরেছেন। দীর্ঘ এ বৈঠকপর্বে তারেক রহমানও উপস্থিত ছিলেন।
লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে নয়, বিভিন্ন বিষয়ে সাধারণ আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। সেখানে কী আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে শফিকুর রহমান বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যে প্রায় ১১ দিনের সফর শেষ করে গত সোমবার তিনি দেশে ফেরেন। এই সফর সম্পর্কে জানাতে বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেল ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দলটি।
জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর মতো বিএনপিও জুলুমের শিকার হয়েছে। ব্যক্তি হিসেবে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও জুলুমের শিকার। দেশ থেকে যাওয়ার আগে আমরা চিন্তা করেছিলাম (খালেদা জিয়ার সঙ্গে) একটা সাক্ষাৎ হবে। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, সেটি আমরা করতে পারিনি। ইউরোপ সফরে যাওয়ার পর আমার এক পরিবারের সদস্যের সঙ্গে দেখা করতে সেখানে (যুক্তরাজ্য) গিয়েছি। এরপর খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছি।’
এই দেখা করার মূল উদ্দেশ্য তাঁর (খালেদা জিয়া) খোঁজখবর নেওয়া ছিল বলে উল্লেখ করেন শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, তাঁরা তাঁদের অতি সম্মান ও ভালোবাসার সঙ্গে গ্রহণ করেন। যেহেতু তিনি তাঁর ছেলে ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বাসায় অবস্থান করছেন, কাজেই তিনিও (তারেক রহমান) সেখানে থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। তিনিও ছিলেন। দুই দলের দায়িত্বশীল ব্যক্তি এক জায়গায় বসলে সেখানে রাজনীতির কথা হবে না, এটা কি বাস্তব! বাস্তব নয়। কথা তো হয়েছে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়নি। নির্বাচন কখন হবে, কীভাবে হবে, বিচারপ্রক্রিয়া কীভাবে হবে, না হবে—বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাধারণ আলোচনা হয়েছে।
জামায়াতের আমির বলেন, রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু সেটা যেন মতবিরোধে রূপ না নেয়। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই মতপার্থক্য থাকুক, নয়তো রাজনীতিবিদেরা অন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এ–ও প্রত্যাশা করি, এটি যাতে মতবিরোধে রূপ না নেয়। ওটা পার্থক্য পর্যন্ত থাকুক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের রাজনীতিবিদেরা অনেক সময় বিষয়গুলো খেয়াল করেন না বা করি না। এটা করতে হবে। যদি আমরা দেশকে ভালোবাসি, তাহলে এই ভালোবাসার, শ্রদ্ধার জায়গায়, মিউচুয়াল রেসপেক্টের জায়গায় আসতে হবে। আমার ওপিনিয়ন (মতামত) আমি দিব, কিন্তু এটা বলতে পারব না যে এটাই করতে হবে। আমি ওপিনিয়ন দিয়ে বলব যে এটা করলে আমার দেশ ও জাতির উপকার হবে। আর এটা আমি করতে দিব না, যে যা–ই চাক, এটাও রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ভাষা নয়।’
– নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াতের হঠাৎ ইউটার্ন
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গতবছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলে নির্বাচন প্রশ্নে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের মতভিন্নতা দেখা দেয়। বিএনপি যেখানে প্রথম থেকেই যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে সংস্কার কাজ এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে বলে আসছিল, জামায়াত সেখানে গুরুত্ব দিয়ে আসছিল সংস্কার ও আওয়ামী লীগের বিচার শেষে নির্বাচন আয়োজনের ওপর। ফলে রাজনীতির মাঠে এই দুই পুরোনো মিত্রের সম্পর্ক শত্রুতার পর্যায়ে নেমে আসার উপক্রম হয়। দুই দলের শীর্ষ নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে আকমণাত্মক বক্তব্য দিতে শুরু করেন। একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা নিয়েও কথা বলতে ছাড় দেননি বিএনপি নেতারা। অন্যদিকে ৫ আগস্টের পর দেশব্যাপী বিএনপি নেতাদের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব হয়ে ওঠেন জামায়াত নেতারা।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও রাষ্ট্রসংস্কার প্রশ্নে এমন পরস্পবিরোধী অবস্থানের মধ্যেই রোববার (১৩ এপ্রিল) লন্ডনে দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক মিত্র বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পরই মূলত জাদুমন্ত্রের মতো বদলে যায় জামায়াত আমিরের বক্তব্য। তিনি তার আগের অবস্থান পরিবর্তন করেন। এখন তিনি বিএনপির সুরে সুর মিলিয়ে আগামী বছর ফেব্রুয়ারি মাসে, অর্থাৎ রোজা শুরুর আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন চান। অন্তর্বর্তী সরকারকে আর সময় দিতে চান না জামায়াতের আমির।
নির্বাচন ইস্যুতে আগের অবস্থান থেকে সরে এসে বুধবার দুপুরে ঢাকায় সফররত মার্কিন ডেপুটি হেড অব মিশনের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল চুলিকের সঙ্গে বৈঠক শেষে ড. শফিকুর রহমান বলেন, ‘তারা (মার্কিন প্রতিনিধি দল) শুধু এটাই জানতে চেয়েছেন, কখন আমরা এই নির্বাচন অনুষ্ঠানটা দেখতে চাচ্ছি। আমরা বলেছি যে, প্রধান উপদেষ্টা চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা আগামী বছরের জুনের মধ্যে ইলেকশন দেওয়ার কথা বলেছেন। তার কমিটমেন্টে তিনি ঠিক আছেন কি না, তা আমরা দেখতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ভিউ হচ্ছে, এটা (জাতীয় সংসদ নির্বাচন) রমজানের আগেই শেষ হয়ে যাক। ওই জুন পর্যন্ত অপেক্ষা, কখনো বর্ষা, ঝড়ঝাপটা, বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসবে, তখন আবার ইলেকশনটা না হওয়ার আশঙ্কা দেখা যাবে। তাই আমরা চাচ্ছি, ওই আশঙ্কার আগেই, অর্থাৎ রমজানের আগেই এইটা (সংসদ নির্বাচন) হয়ে যায়, সেটা আমাদের মতামত।’ জামায়াত তাহলে আগামী রোজার আগেই নির্বাচন চাইছে কি না?— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, শুধু আগামী না। আগামীতে অনেক রোজাই আসবে। ২০২৬ সালে যে রমজান আসবে সেই রমজানের আগেই নির্বাচনটা হয়ে যাক, সেটা আমরা চাই।’
জামায়াত আমিরের এই বক্তব্যে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কৌতুহলের জন্ম দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, হঠাৎ এমন কী হল যে, একেবারে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেল জামায়াত? দলীয় সুত্রগুলো বলছে, নির্বাচনহীন দেশ দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এটা আর বাড়াতে চাচ্ছে না দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলো। এরই অংশ হিসেবে রোববার খালেদা জিয়া ও তারেকর রহমানের সঙ্গে বৈঠকে হয়ত দ্রুত নির্বাচনের ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছেছে জামায়াত-বিএনপি।
জানা গেছে, পুরোনো মিত্র জামায়াতের এই ইউটার্নে স্বস্তি ফিরে পেয়েছে বিএনপি। ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ ইস্যুতে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, হেফাজতে ইসলাম এবং রাজনীতির মাঠে নতুন শক্তি জাতীয় নাগরিক পার্টির একমত হলেও দ্রুত নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপি একেবারেই একা হয়ে পড়েছিল। নির্বাচন ইস্যুতে চার বড় শক্তি ছিল একদিকে, আর বিএনপি ছিল আরেক দিকে। সেরকম একটা পরিস্থিতিতে জামায়াতের এই ইউটার্ন বিএনপিতে স্বস্তি এনে দিয়েছে।
Share this content:
Post Comment