ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও কড়া প্রতিবাদ জানালো ‘অখন্ড বাংলাদেশ আন্দোলন’

  • বাংলাদেশিদের নিয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও শিষ্টাচার বহির্ভূত।
  • ঝাড়খন্ডে বাংলাদেশিরা নয়, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ গংরাই অনুপ্রবেশকারী।
  • পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, আন্দামান, বিহার ও উড়িষ্যায় গণভোটের দাবি।

লণ্ডন, ২৪ সেপ্টেম্বর- সম্প্রতি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঝাড়খণ্ডে এক দলীয় জনসভায় বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশকারী উল্লেখ করে ‘উল্টো করে ঝুলিয়ে সোজা করে দেওয়ার’ যে হুমকি দিয়েছেন, তার তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ ও  চরম অসন্তোষ জানিয়েছেন ‘অখন্ড বাংলাদেশ আন্দোলন’ এর নেতৃবৃন্দ।

‘অখন্ড বাংলাদেশ আন্দোলন’ এর আহবায়ক হাসনাত আরিয়ান খান স্বাক্ষরিত এক প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, “এই প্রথমবার নয়, অমিত শাহ এর আগেও বাঙালি ও বাংলাদেশিদের উদ্দেশ্য করে কটূক্তি করেছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী অন্তত দুবার তিনি বাংলাদেশিদের ‘অনুপ্রবেশকারী উইপোকা’ বলেছেন, একবার তিনি ‘বঙ্গোপসাগরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া’র কথা বলেছেন। শুধু যে অমিত শাহ এ ধরণের অশোভন, আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য করেছেন, তা নয়। নরেন্দ্র মোদিসহ বিজেপির অন্যান্য নেতাদের মুখেও এধরনের বাজে মন্তব্য শোনা গেছে। যা চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও শিষ্টাচার বহির্ভূত। ভারতের ক্ষমতাসীন দল ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের মুখে এধরনের কুৎসিত, অশালীন বক্তব্য কাম্য নয়। আমরা এমন অশোভন, কুৎসিত, আপত্তিকর, অগ্রহণযোগ্য বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আমরা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই- ঝাড়খন্ড, বিহার, উড়িষ্যা, ছত্তিসগড়, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল ও  আন্দামানে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ গংরাই অনুপ্রবেশকারী, বাংলাদেশিরা নয়, বাঙালিরা নয়।”

প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, “বাঙালিরা এ অঞ্চলের ভূমিপুত্র। সমগ্র বাংলা বলয়ের মাটি বাঙালি/বাংলাদেশিদের পূর্বপুরুষদের মাটি। বাঙালিদের রয়েছে এখানে থাকার নিঃশর্ত অধিকার। কেন্দ্রীয় বাংলা বলতে আজ বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ বোঝালেও প্রান্তিক বাংলা—ত্রিপুরা, আসাম, আন্দামান, আরাকান, বিহার, থেকে উড়িষ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত। পরবর্তীতে বিহার ভেঙ্গে ঝাড়খন্ড প্রদেশ ও উড়িষ্যা ভেঙ্গে ছত্তিসগড় প্রদেশ এবং আসাম ভেঙ্গে মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড আর অরুণাচল প্রদেশ তৈরি করা হলেও এই পুরো অঞ্চলেই বাঙালি এবং বাঙালিদের কাছাকাছি নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করেন। এ আমাদের নবাবি বাংলা, শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ’র বাংলা, সিরাজ-উদ-দৌলা’র বাংলা। এ আমাদের সুবা বাংলা, শাহ বাংলা, সেন বাংলা, পাল বাংলা, বাংলা সালতানাতের ভূমি। বাঙালির দেশ। নৃ-বিজ্ঞান এবং জেনেটিক সায়েন্সের তথ্য-প্রমাণ মতে বাঙালি সনাতন, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা আমরা একই জনগোষ্ঠীর লোক, একই রক্তের একই পূর্বপুরুষের বংশধর। অনিবার্যভাবেই এ অঞ্চল আমাদের ঠিকানা। বস্তুত বাঙালি এবং বাংলা বলয় চেতনে-অবচেতনে বিজেপির কাছে আতঙ্কজনক এক প্রতিপক্ষ। কাজেই ভারত জুড়ে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত, শতধা ছিন্নভিন্ন এই বাঙালিকে হীন করতে, কোণঠাসা করতে তারা মরিয়া। তারা চায় বাংলা বলয়ের ভূমির দখল, তারা চায় বাংলা বলয়ের মেরুদণ্ড বাঙালিদের উৎখাত করতে, তারা চায় বাংলা বলয়ের সংস্কৃতি এবং ইতিহাসকে নিশ্চিহ্ন করতে। তারা চায় বাংলাদেশকে বৃত্তবন্দী করতে। ফলে জরুরি হয়ে উঠেছে বাঙালি খেদানো। যে বাঙালির বাংলা বা বাংলা বলয়, সেখান থেকে বাঙালি খেদানোর চিন্তা করাও এক ঘোরতর নৈতিক অপরাধ।”

প্রতিবাদলিপিতে আরো বলা হয়,  “বাংলার বিরাট ভূখণ্ডের ভূমিপুত্ররা নিজ ভূখণ্ডে একাধিকবার গণহত্যার শিকার হয়েছে, এথনিক ক্লিনজিংয়ের শিকার হয়েছে আর এখন এনআরসি’র জাঁতাকলে মরছে। আসাম থেকে ৪০ লাখ বাঙালিকে তারা বের করার পরিকল্পনা করছে। ভারতের দখলে থাকা বাঙালি অধ্যুষিত প্রদেশগুলো থেকে বাঙালিদের তাড়াতে নরেন্দ্র মোদি সরকার জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) প্রণয়নের ঘোষণা দিয়েছে। নাগরিকপঞ্জির আড়ালে তারা কৌশলে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী মানুষের নাগরিকত্ব বাতিল করার চক্রান্ত করছে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় হিন্দু পরিষদ ও রাষ্ট্রীয় বজরং দল বাংলাদেশি মুক্ত ভারতের কথা উল্লেখ করে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। ইতোমধ্যে আসামে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করে নতুন করে নাগরিকপঞ্জি তৈরী করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সেখানে ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন বাঙালিকে নাগরিকত্বহীন করা হয়েছে। তাঁদের পাসপোর্ট, আধার কার্ড, রেশন কার্ড, জমানো টাকা, বাড়ি-ঘর, জমির দলিল সবই কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন নাগরিকত্বহীন মানুষ বর্তমানে ডিটেনশন ক্যাম্পে খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছে। ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা ও আন্দামানেও এই বিল আনার তোড়জোড় চলছে। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীন অংশটাকেও টুকরো করার অবিরাম ষড়যন্ত্র চলছে। দেশের পার্বত্য অঞ্চলকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা তারা করছে। পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি বাহিনী তারাই তৈরী করেছে। কেএনএফকে তারাই অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কুকি-চিন, গারো ও চাকমাদের তারা বাঙালিদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত উস্কে দিচ্ছে। তাদের স্পষ্ট লক্ষ্য এবং শিকার যে বাঙালি জনগোষ্ঠী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভারতে রীতিমতো ‘বাঙালি’ এবং ‘বাংলাদেশি’ শব্দ দুটো প্রায় ভয়ংকর অপমানজনক শব্দে পরিণত হয়েছে। এর পরিণতি ভালো হবে না। বিজেপি সরকারকে আমরা সাবধান করে দিচ্ছি, বাংলাদেশি ও বাঙালি আজাদি পাগল জনগণকে নিয়ে খেলার চেষ্টা করা হলে এর পরিণতি ভালো হবে না।”

পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, আন্দামান, বিহার ও উড়িষ্যায় গণভোটের দাবি করে প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, “ভারত রাষ্ট্রটির জন্ম ১৯৪৭ সালে। কিন্তু এই ভূমি তো ১৯৪৭ সালে রচিত হয়নি! এই মানুষ, মানুষের পূর্বপুরুষ, ভূমিপুত্ররা তো ১৯৪৭ সালেই এ অঞ্চলের বাসিন্দা হয়নি! বাঙালিরা যুগ যুগ ধরে আছে নিজভূমে, বাঙালিদেরই এলাকায়। একটি বিরাট জনগোষ্ঠীকে তার নিজভূমে পরবাসী বানানোর সিদ্ধান্ত ন্যায়ত কোনো আইন হতে পারে না। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করি। আমরা বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, আন্দামান, আরাকান, মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল, বিহার, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা ও ছত্তিসগড় নিয়ে একটি বৃহত্তর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দাবি করি। আমরা আমাদের বাংলা বলয়ের সকল বাংলাভাষীর জন্য একটি অখন্ড বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দাবি করি। এই আধুনিক যুগে এসে আমরা যুদ্ধ চাইনা, আমরা কোন রক্তপাত চাই না। আমরা দিল্লীর শাসকদের কাছে এর একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান কামনা করি। অখন্ড বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে, স্বাধীনতার প্রশ্নে আমরা পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, আন্দামান, মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল, বিহার, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা ও ছত্তিসগড়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ গণভোটের দাবি করি। গণভোটে জনগণ যে রায় দিবে, সেই রায় আমরা মেনে নিবো।” 

উল্লেখ্য, ঝাড়খণ্ডের গিরিডিতে একটি জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ। ওই ভাষণের যে ভিডিও দেখা যায়, তাতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একাধিকবার রোহিঙ্গা, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়টি নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেছেন, “ঝাড়খণ্ডে একবার সরকার বদল করুন। আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, ঝাড়খণ্ড থেকে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে খুঁজে বের করে ঝাড়খণ্ড থেকে তাড়ানোর কাজটি ভারতীয় জনতা পার্টি করবে। তারা আমাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তারা আমাদের সম্পত্তি দখল করে নিচ্ছে। তারা আমাদের রোজগারপত্রও লুঠ করছে। ঝাড়খণ্ডে অনুপ্রবেশকারীদের কোনও জায়গা নেই, একমাত্র বিজেপি সরকারই এটা করতে পারে। আমি আজ বলে যাচ্ছি, আপনারা এখানে পদ্ম ফুলের সরকার বানান, এইসব অনুপ্রবেশকারীদের উল্টো করে ঝুলিয়ে সোজা করার কাজটা আমরা করব।” ওই বক্তব্যের প্রতিবাদে সোমবার ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের কাছে প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রতিবাদপত্রে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বাংলাদেশ সরকার এ ধরনের আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপি-জামায়াতসহ বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর জ্যেষ্ঠ নেতারাও অমিত শাহ’র বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছেন। 

Share this content:

Post Comment

অন্যান্য