পুলিশের ভেতরে থাকা স্বৈরাচারের আস্থাভাজনরা কাজে বাধা!

ঢাকা অফিস- পুলিশ বাহিনীর কাজে গতি ফেরাতে বাধা হিসেবে কাজ করছে স্বৈরাচার সরকারের আস্থাভাজন পুলিশ কর্মকর্তারা। সে সময়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা পুলিশের ভেতরে থাকা তাদের দোসরদের দিয়ে নানা কূটকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে; যাতে বাহিনীর ভেতরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে পলাতক থাকা কর্মকর্তারা নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করে যাচ্ছেন এখনো। তবে তাদের এসব ষড়যন্ত্র সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন না হলেও বিভ্রান্ত হচ্ছেন নতুনভাবে কাজে মনোযোগী পুলিশ সদস্যরা। বিশেষ করে বিভিন্ন এলাকা ও স্থান থেকে বদলি হয়ে আসা নতুনরা অনেকটাই ঘাবড়ে যাচ্ছেন।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, চাকরিজীবনে ১৫-২০ বছর অনেকেই ঢাকার মুখ দেখেননি। নানা অজুহাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বদলি করে রাখা হয়েছিল। দেশের এ চরম অবস্থায় রাজধানীর মতো জায়গায় শৃঙ্খলা ফেরাতে ওই সব বঞ্চিতকেই আনা হয়েছে। তার ওপর বাহিনীর মধ্যে থাকা ফ্যাসিবাদীদের অনেকেই আকারে ইঙ্গিতে ভয়ভীতি দেখিয়ে কাজের গতি নষ্ট করার চেষ্টা করছে।

অভিযোগ রয়েছে, স্বৈরাচারের দোসর পুলিশ সদস্যদের কূটকৌশলে এখনো শতভাগ কার্যক্রম চালাতে বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে পুলিশ বাহিনীকে। এসব দোসর বিভিন্ন স্থান থেকে বদলি হয়ে আসা নতুন কর্মকর্তাদের মধ্যে ছাত্র-জনতার ভয়, শেখ হাসিনা আবার ফিরে আসলে, তখন তোমাদের কী হবে এসব ভয় ঢুকিয়ে নানাভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এমনকি পালিয়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ ফেসবুকেও বিভ্রান্তকর পোস্ট দিচ্ছেন।

সূত্রমতে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়। বিভিন্ন সেনানিবাসে যে ৬২৬ জন আশ্রয় নিয়েছিলেন তার মধ্যে ৫১৫ জনই ছিলেন পুলিশ সদস্য। যার মধ্যে ২৮ জন কর্মকর্তা ও ৪৮৭ জন বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্য। পুলিশ সদর দফতরের তথ্যানুযায়ী ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৮৭ জন সদস্য এখনো কর্মস্থলে যোগ দেননি। তবে এর বাইরেও অনেক পুলিশ সদস্য নানা কৌশলে বা কারণ দেখিয়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। আবার পুলিশের যেসব প্রভাবশালী কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে বেশির ভাগই পলাতক। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ওপর গুলির নির্দেশ দিয়ে হতাহত করেন তারা গ্রেফতার না হওয়ায় (জসিম উদ্দিন মোল্লা ছাড়া) জনমনেও ক্ষোভ বিরাজ করছে। বিশেষ করে গ্রেফতার নিশ্চিত না করে যারা তাদেরকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জোরালো হচ্ছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পুলিশের পলাতক কর্মকর্তাদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। পলাতক হিসেবে হারুনকে পুলিশ সদর দফতরের তালিকায় ১ নম্বরে রাখা হয়েছে। ৫ আগস্টের আগে-পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে হতাহতের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামির তালিকায়ও শীর্ষে রয়েছেন এই হারুন। এসব মামলার মধ্যে ২০১১ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ বিএনপি নেতা জয়নাল আবদিন ফারুককে মারধর করে লাইমলাইটে আসেন তিনি। ১৩ বছর পর গত ১৯ আগস্ট জয়নাল আবদিন ফারুক নিজেই সেই ঘটনায় বাদি হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। আলোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০টি মামলায় নাম পাওয়া গেছে।

এ ছাড়া গ্রেফতার এড়াতে পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার দেশ ছাড়ার গুঞ্জন রয়েছে। আবার কেউ শিক্ষা ছুটি, কেউবা অসুস্থতার কথা বলে কিংবা লিয়েন (অনুমোদন নিয়ে অন্যত্র চাকরি) নিয়ে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করছেন কেউ কেউ।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) মো: জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, যেসব পুলিশ সদস্য এখনো কাজে যোগ দেননি, লুকিয়ে আছেন, তাদের আর যোগ দিতে দেয়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিশ্চয়ই তারা কোনো অপকর্মে জড়িত, এ কারণে কাজে যোগ দিচ্ছেন না। এমন পুলিশ সদস্যের সংখ্যা নগণ্য। তাদের বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

জনশ্রুতি রয়েছে লালমনিরহাটের পাটগ্রামের দহগ্রাম ইউনিয়ন সীমান্ত পথ দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে চলে গেছেন আর এক কর্মকর্তা ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার। ১০ সেপ্টেম্বর রাতে কোনো একসময় তিনি ভারতে প্রবেশ করেন। দেশ ছাড়ার চেষ্টাকালে ব্যর্থ হন সাবেক ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। ৫ আগস্টের পর থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো: আসাদুজ্জামানসহ শীর্ষ পর্যায়ের অন্তত ২৩ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। অবসরে যাওয়ার আগে তাদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে ছিলেন।

পুলিশে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন যারা : গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার গুলির ঘটনায় পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। এসব মামলায় পুলিশের সাবেক দুই আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এবং এ কে এম শহীদুল হক, ডিবির ডিসি মশিউর রহমান, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: আব্দুল্লাহিল কাফী ও ডিএমপির মিরপুর জোনের সাবেক ডিসি জসিমউদ্দিন মোল্লা, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচিত অন্তত আট সদস্যকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে।

গ্রেফতারের জন্য খোঁজা হচ্ছে যেসব কর্মকর্তাকে : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে অনুমতি নেয়া হয়েছে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের জন্য। তারা হলেন0 ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান, ঢাকার সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাহিদুর রহমান, ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের সাবেক উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন, ওয়ারী জোনের সাবেক অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) এস এম শামীম, উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো: তৌহিদুল ইসলাম, ট্রাফিক ওয়ারী বিভাগের সাবেক সহকারী কমিশনার তানজিল আহমেদ ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) উত্তরার সহকারী পুলিশ সুপার (চট্টগ্রামের হাটহাজারী মডেল থানার সাবেক ওসি) মো: রফিকুল ইসলাম। এখন পর্যন্ত শুধু ঢাকায় পুলিশের কমপক্ষে ৯৯ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও অপহরণে জড়িত থাকার অভিযোগে মামলা হয়েছে।

আত্মগোপনে যারা : কর্মস্থলে যোগ না দেয়া ১৮৭ সদস্যের যে তালিকা পুলিশ সদর দফতর দিয়েছে, এর মধ্যে ডিআইজি থেকে সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা আছেন ১৬ জন। পুলিশ পরিদর্শক আছেন পাঁচজন, উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার কর্মকর্তা আছেন ১৪ জন। অন্যদের মধ্যে এএসআই ৯ জন, নায়েক সাতজন ও কনস্টেবল ১৩৬ জন। পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, কাজে যোগ না দেয়া শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো: মনিরুজ্জামান (স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসরের আবেদন করেছেন), ডিএমপির সাবেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, ডিবির সাবেক যুগ্ম কমিশনার খোন্দকার নুরুন্নবী, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান, রংপুর মহানগর পুলিশের (আরপিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার উত্তম কুমার পাল এবং পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার। পুলিশ সুপার থেকে সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার আত্মগোপনে থাকা অন্য আট কর্মকর্তা হলেন0 আরপিএমপির উপপুলিশ কমিশনার মো: আবু মারুফ হোসেন, আরপিএমপি ডিবির উপপুলিশ কমিশনার মো: শাহ নূর আলম, ডিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার মফিজুর রহমান ও মো: ইফতেখার মাহমুদ, আরপিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার মো: আরিফুজ্জামান ও মো: আল ইমরান হোসেন এবং সিরাজগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার রানা। পরিদর্শক পদে কর্মস্থলে যোগ না দেয়া কর্মকর্তারা হলেন লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থানার সাবেক ওসি মো: মাহফুজার রহমান, কুমিল্লার সদর দক্ষিণ মডেল থানার পরিদর্শক খাদেমুল বাহার বিন আবেদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর সার্কেলের পরিদর্শক মো: ইউসুফ হাসান, ডিএমপির সাবেক পরিদর্শক জাকির হোসাইন ও ঢাকা জেলা পুলিশের পরিদর্শক মো: আরাফাত হোসেন।

পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, পুলিশ একটি শৃঙ্খল বাহিনী। যারা এই বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা ঘটানোর চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে পুলিশের কাজে বাধা দেয়াও একটি বড় অপরাধ। আমাদের নিজস্ব মেকানিজম রয়েছে। এসব বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ সজাগ দৃষ্টি রাখছি।

Share this content:

Post Comment

অন্যান্য