ঢাবিতে অর্ধশতাধিক শিক্ষককে নিয়ে বেকায়দায় প্রশাসন
ঢাকা অফিস- ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর পাল্টে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পক্ষে যে সকল শিক্ষক অবস্থান নিয়েছিলেন তাদের নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য ছাত্র-শিক্ষকদের তোপের মুখে পড়েন তারা। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে ঢাবির সকল কার্যক্রম থেকে অন্তত অর্ধশত শিক্ষককে বয়কট করেছেন শিক্ষার্থীরা। বয়কটকৃত এসব শিক্ষক ঢাবির ক্লাস-পরীক্ষা, টিউটোরিয়াল, থিসিসসহ কোনো একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না বলে শিক্ষার্থীরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে নীরব ভূমিকায় রয়েছে ঢাবি প্রশাসন। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে এসব শিক্ষকদের নিয়ে বিপাকে পড়া প্রশাসন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানান, কোটা আন্দোলনকে ঘিরে শুরু হয় এ অভ্যুত্থান। প্রথমে ৯ দফা, তারপর সরকার পতনের একদফা। টানা ৩৬ দিনের ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। সরকারদলীয় সমর্থক ও পুলিশের হামলাতে রক্তাক্ত হয়ে ওঠা আন্দোলনে প্রাণ হারান হাজারো মানুষ।
১৫ই জুলাই ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ছাত্রলীগ নজিরবিহীন হামলা করলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। সেই হামলা থেকে ৫ই আগস্ট সরকার পতন পর্যন্ত নিপীড়িত শিক্ষার্থীদের পাশে না দাঁড়িয়ে গণআন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালানোর অভিযোগ উঠেছে বয়কট হওয়া শিক্ষকদের বিরুদ্ধে।
আন্দোলনে সাহস জোগাতে ঢাবি শিক্ষকদের একটি পক্ষ যেমন শিক্ষার্থীদের নানা পরামর্শ ও সহায়তা করেছেন, তেমনি আন্দোলনের বিপক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছিলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক দল শিক্ষক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা বিতর্কিত পোস্ট করাসহ প্রকাশ্যে শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার ‘বিনষ্টের’ হুমকিও দিয়েছেন তারা। আন্দোলনের কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হওয়া ক্যাম্পাস গত ২২শে সেপ্টেম্বর চালু হয়। এরপর থেকেই বিতর্কিত এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে সরব হয় শিক্ষার্থীরা।
বিভিন্ন বিভাগে খোঁজ নিয়ে ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নীলদলপন্থি এই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মোটাদাগে তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রকাশ্যে বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হয়রানি-হুমকি ও আন্দোলনবিরোধী বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগে শিক্ষার্থীরা বয়কট করেছেন ছয় শিক্ষককে। এরমধ্যে ব্যাপক অভিযোগ থাকায় অধ্যাপক ড. ফাজরীন হুদাকে সব ধরনের বিভাগীয় কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বাকি পাঁচজন শিক্ষককে আন্দোলন চলাকালীন সরকারের পক্ষ নিয়ে নানা প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা ও দুঃখ প্রকাশের আহ্বান জানানো হয়। তবে এখন পর্যন্ত সেটি না করায় তাদের কোনো ক্লাসে শিক্ষার্থীরা অংশ নিবেন না বলে জানিয়েছেন। এই পাঁচ শিক্ষক হলেন- ইনজামাম মাহবুব, সাদিয়া আফরিন, দেবাশিষ দাস, নিলয় রায় ও রহিমা আক্তার। পূজার ছুটির পর এ নিয়ে ফের বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবু সায়েমের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন বিভাগটির শিক্ষার্থীরা। বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষার্থী বিরোধী অবস্থানের কারণে এই পাঁচ শিক্ষককে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন চেয়ারম্যান। সেটি তারা মেনে নেননি। শেষ পর্যন্ত সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারলে একাডেমিক সংকট কাটানোর জন্য খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগের পরিকল্পনা আছে বিভাগ কর্তৃপক্ষের।
আইন বিভাগের অধ্যাপক ও বর্তমান আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল চাপ উপেক্ষা করে শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ালেও বিভাগটির চারজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে সরাসরি আন্দোলনের বিরোধিতা করার অভিযোগ উঠেছে। এই চারজনকে ইতিমধ্যে বয়কট করেছে বিভাগটির শিক্ষার্থীরা। তারা হলেন- অধ্যাপক ড. রহমতুল্লাহ, অধ্যাপক ড. জামিল আহমেদ চৌধুরী, প্রভাষক আজহার উদ্দিন ভূঁইয়া ও শাহরিমা তানজিম অর্নি।
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে শিক্ষার্থীদের বয়কট ও তোপের মুখে বিভাগীয় কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে চারজন শিক্ষককে। এরমধ্যে আন্দোলনে যোগ দেয়া শিক্ষার্থীদের হামলা-মামলার ভয় দেখানোর অভিযোগ উঠেছে এর আগেও নানা কারণে আলোচিত অধ্যাপক আ.ক.ম জামাল উদ্দীনের বিরুদ্ধে। দাবির মুখে ইতিমধ্যে তাকে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দিলেও শিক্ষার্থীরা তার স্থায়ী বহিষ্কার চান। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ও আন্দোলনের সময় বিভাগের শিক্ষার্থী রাহুলকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি জানানোর পরও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় অধ্যাপক জিনাত হুদাকে চেয়ারম্যান থেকে অপসারণ ও বিভাগ থেকে অব্যাহতির দাবি করেছে শিক্ষার্থীরা। তবে আগেও নানা কর্মকাণ্ডে বিতর্কের জন্মে দেয়া ঢাবি শিক্ষক সমিতির এই নেতা সরকার পতনের পর থেকে আর বিভাগে আসছেন না। এ ছাড়াও বিভাগের শিক্ষক এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম ও অধ্যাপক ড. মশিউর রহমানকেও বয়কট করেছে শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাজমুস সাকিব ও সুমাইয়া ইকবালকে বয়কট করা হয়েছে। শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের দুই শিক্ষক অধ্যাপক ড. অহিদুজ্জামান চাঁন ও মাহবুবুর রহমান লিটুকে বয়কটের পর তাদের পদত্যাগের জন্য আন্দোলন করছেন বিভাগটির শিক্ষার্থীরা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যাপক তানজিম উদ্দীন খানসহ অনেক শিক্ষকই আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছেন। তবে এ সময় নীরব থাকা ও প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা রাখার অভিযোগ উঠেছে বিভাগটির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক লিলুফার ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে। বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করার পর সব শিক্ষক ভুক্তভোগীর পক্ষে অবস্থান নিলেও তিনি নেননি। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সমপ্রতি চেয়ারম্যান পদ ছেড়েছেন এই শিক্ষক। এদিকে অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের নাজমুস সাকিব ও সুমাইয়া ইকবাল নীল দলের হয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনবিরোধী বিতর্কিত সমাবেশে উপস্থিত থাকার কারণে বয়কট করেছেন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের বিভিন্ন বিভাগেও আন্দোলনে ছাত্রদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় বয়কট করা হয়েছে অনেক আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের। এরমধ্যে ম্যানেজমেন্ট বিভাগে চার জন শিক্ষককে সর্বাত্মকভাবে বর্জন করেছেন শিক্ষার্থীরা। অবশ্য বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোশারফ হোসেন ও সুমন দাসকে বয়কট করা হয়েছে নারী শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির অভিযোগে। আর আন্দোলনে অসহযোগিতা করার জন্য বয়কট করা হয় মুশিক মান্নান চৌধুরী আর শবনম জাহানকে। একই কারণে মার্কেটিং বিভাগের তিন শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক মিজানুর রহমান ও আরেক শিক্ষক মিজান রহমানকে। অ্যাকাউন্টিং বিভাগে শিক্ষার্থীদের বয়কট করা চার শিক্ষক হলেন- অধ্যাপক ড. মুশফিকুর রহমান, জামিল শরিফ, মাহমুদা আখতার ও সহযোগী অধ্যাপক মনিরুজ্জামান। তাদের বিরুদ্ধে শেষদিকে নীল দলের বিতর্কিত প্রোগ্রামে উপস্থিত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলেন এই চার শিক্ষক। ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টসহ অনুষদের অন্যান্য বিভাগে আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষককে বয়কট করেছে শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান অনুষদেও বিতর্কিত শিক্ষকদের ব্যাপারে ক্যাম্পাস খোলার পর থেকে সরব ছিলেন শিক্ষার্থীরা। জীব বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ও বায়ো কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ড. এ কে এম মাহবুব হাসান, অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের আজমল হোসেন ভূঁইয়া, গণিত বিভাগের চন্দ্রনাথ পোদ্দারসহ প্রায় এক ডজন শিক্ষককে বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অবস্থান জানতে চাইলে প্ল্যাটফরমটির কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তাহমিদ আল মুদ্দাসির চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই আন্দোলন করছে। তাদের অব্যাহতি দেয়ার ক্ষমতা নেই বিধায়, তারা বয়কটের ডাক দিয়েছে। কোনো ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারের দোসরকে শিক্ষক হিসেবে দেখতে চান না বলে এই সমন্বয়ক জানান, আমরা প্রত্যাশা করি সবগুলো অভিযোগ আমলে নিবে এবং সঠিক তদন্ত করবে। এতে দোষী প্রমাণিত হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থাও নেয়া হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক-ছাত্র দ্বন্দ্বের ব্যাপারে আমরা অবগত আছি। পাঁচটি স্তরে এটি নিরসনের পরিকল্পনা রয়েছে প্রশাসনের। বিভাগ, অনুষদসহ অন্যান্য মধ্যস্থতায় সমস্যার সমাধান না হলে বিষয়টি সিন্ডিকেট আসবে। তখন অভিযোগের গুরুত্ব বুঝে তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে পুরো প্রক্রিয়াটি যাতে শতভাগ স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতার সঙ্গে হয় সেটি আমরা নিশ্চিত করবো। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের আবেগ ও মতামতকে আমরা সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা করি এবং গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। তবে কেউ যাতে কোনো রকম অবিচারের শিকার না হয় সেদিকেও আমাদের লক্ষ্য থাকবে।
Share this content:
Post Comment