এটা বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা : ড. ইউনূস
- দেশবাসীকে ড. ইউনূসের তিন বার্তা।
- সরকারের ওপর দ্রুত আস্থা ফিরিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ।
- বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে সেভেন সিস্টার্স অস্থিতিশীল হবে।
লণ্ডন, ৭ আগস্ট- প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে পালিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। এমতবস্থায় ছাত্রজনতার এ বিজয়কে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে মন্তব্য করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিভিন্ন গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
ড. ইউনূস বলেন, আমরা অধীকৃত দেশের মতো ছিলাম। তাদের মনোভাব ছিল একনায়কতন্ত্রের মতো। তারা সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করত। এখন বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীন। এটা বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। এখন আনন্দে মেতে উঠেছে সারা বাংলাদেশের জনগণ। সব জায়গায় আনন্দ মিছিল হচ্ছে। আন্দোলনরত সবাইকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, এখন আমরা আনন্দ অনুভব করছি। আমাদের এখানে অনেক সমস্যা আছে। আমরা এখন নতুন করে শুরু করতে চাই। আমাদের জন্য সুন্দর একটি দেশ তৈরি করতে চাই। এটা আমাদের অঙ্গীকার। ছাত্র-জনতাই আমাদের ভবিষ্যত। আমরা তাদের নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেছেন, আমরা মুক্ত। এখন আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারব আসলে আমরা কী করতে চাই। আশা করছি আমরা খুব ভালোভাবে শুরু করতে পারব।
বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতিতে আপনার অবস্থান কী হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আমি জনগণের জন্য কাজ করে যাবো, আমি যেটা করতাম। আমি এখন স্বাধীনভাবে আমার কাজ করে যেতে পারব। আপনারা জানেন যখন শেখ হাসিনা সরকারে ছিল তিনি আমাকে পারসোনালি আক্রমণ করেছেন। এখন সেটার অবসান হয়েছে।
দেশবাসীকে ড. ইউনূসের তিন বার্তা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জন্য মনোনীত ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশবাসীর উদ্দেশে একটি বার্তা দিয়েছেন। বুধবার (৭ আগস্ট) দুপুরে ইউনূস সেন্টারের পক্ষ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি বক্তব্য গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। তাতে সরকার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্বে দেওয়া ছাত্রনেতাদের পাশাপাশি দেশের আপামর জনসাধারণকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি।
দেশবাসীর উদ্দেশে ড. ইউনূস বলেছেন, ‘আমি সাহসী ছাত্রদের অভিনন্দন জানাই, যারা আমাদের দ্বিতীয় বিজয় দিবসকে বাস্তবে রূপ দিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং অভিনন্দন জানাই দেশের আপামর জনসাধারণকে, যারা ছাত্রদের এই আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের কোনো প্রকার ভুলের কারণে আমাদের এই বিজয় যেন হাতছাড়া হয়ে না যায়। আমি সবাইকে বর্তমান পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে এবং সব ধরনের সহিংসতা এবং স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে আহ্বান জানাচ্ছি।’
ছাত্র-দল-মত-নির্বিশেষে সবাইকে শান্ত থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমাদের প্রিয় এই সুন্দর ও বিপুল সম্ভাবনাপূর্ণ দেশটিকে আমাদের নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রক্ষা করা এবং একে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই এখন আমাদের প্রধান কাজ। একটি নতুন পৃথিবী বিনির্মাণে আমাদের তরুণরা প্রস্তুত। অকারণ সহিংসতা করে সুযোগটি আমরা হারাতে পারি না।’
তিনি বলেন, ‘সহিংসতা আমাদের সবারই শত্রু। অনুগ্রহ করে শত্রু সৃষ্টি করবেন না। সবাই শান্ত থাকুন এবং দেশ পুনর্গঠনে এগিয়ে আসুন। অনুগ্রহ করে নিজে শান্ত থাকুন এবং আপনার আশপাশের সবাইকে শান্ত থাকতে সহায়তা করুন।’
সরকারের ওপর দ্রুত আস্থা ফিরিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ: ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে ড. ইউনূস
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের ওপর দ্রুত আস্থা ফিরিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকাকে এ কথা বলেছেন তিনি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘দেশ পুনর্গঠনে আমরা একসঙ্গে কীভাবে কাজ করতে পারি, সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব দলের সঙ্গে কথা বলব।’
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘নতুন নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত হতে কাজ করা দরকার।’ দেশে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যও একটি রূপরেখা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, মিয়ানমারেও প্রভাব পড়বে
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার আগের দিন নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই হবে নতুন সরকারের প্রথম কাজ। সেটা করা না গেলে, বাংলাদেশ স্থিতিশীল না হলে প্রতিবেশীদের পক্ষে তা হবে বিপজ্জনক। বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর–পূর্বাঞ্চল, মিয়ানমার সর্বত্র প্রভাব পড়বে।
ড. ইউনূস বলেন, ‘মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ ১৭ কোটি মানুষের দেশ। জনসংখ্যার অধিকাংশ যুব সম্প্রদায়। জীবনে তারা কেউ ভোট দিতে পারেনি। সেই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াই হবে প্রধান কাজ। ওখান থেকেই আমাদের শুরু করতে হবে। তাদের বলতে হবে, গণতন্ত্র ফিরে আসবে। তোমরা সবাই হবে তার অংশীদার।’
ভারতের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনডিটিভিকে বুধবার এ সাক্ষাৎকার দেন বাংলাদেশের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশে এতকাল আইনশৃঙ্খলা ছিল না বলেই আজ এই অস্থিতিশীলতা। আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে বলেই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছিল এবং তা করতে তিনি বাধ্য হন। এখন মানুষ সেই পতনের উদযাপন করছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর এটা দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস। প্রথমটা ছিল পাকিস্তানের দাসত্ব থেকে শৃঙ্খলমুক্ত হওয়া, এবার স্বৈরাচারী সরকারের কাছ থেকে। শুরু হয়েছে এক নতুন যুগের। মানুষ এখন মুক্তির স্বাদ নিচ্ছে।
সেই উদযাপন যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে, সেখান থেকেই স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে বলে মন্তব্য করেন মুহাম্মদ ইউনূস। এনডিটিভির আরেক প্রশ্নের জবাবে নোবেলজয়ী বলেন, দেশবাসীকে গণতন্ত্রহীন করে রেখে শেখ হাসিনা দেশকে অস্থিতিশীল করে রেখেছিলেন। মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রই অস্থিতিশীলতার ওষুধ। এবার বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বাদ পাবে। স্বচ্ছ নির্বাচন প্রত্যক্ষ করবে। এই বিপ্লবের মূল লক্ষ্য সেটাই।
ইসলামি মৌলবাদ, উগ্রপন্থা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙে দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে অন্য এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এসব ঘটনার যাবতীয় দায় শেখ হাসিনার। নিজের বাবার ভাবমূর্তি তিনিই নষ্ট করেছেন। দেশের মানুষের মন এমন বিষিয়ে দিয়েছেন যে আজ বীতশ্রদ্ধ হয়ে মানুষ এমন কাজ করছে। এর দায় হাসিনারই।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা ঠিক করাই এখন এক নম্বর কাজ, হাসিনা যে কাজে ব্যর্থ হয়েছেন। সে কারণেই তাঁর সরকার এভাবে হুড়মুড় করে ভেঙে গেল। আইনের শাসন জারি করতে পারলে এমন হতো না। এখন দেশে যা চলছে, তা হাসিনার শাসনের ধারাবাহিকতা। আমাদের এখন এটা নিশ্চিত করতে হবে যে লোকজন উদ্যাপন শেষে ঘরে ফিরে যাবে। কাজে মন দেবে। মুক্তমনে কাজ করবে।’
হাসিনার কী হবে, আপাতত ভারতে থাকলেও কোন দেশে যাবেন, সে সম্পর্কে তাঁর ধারণা আছে কি না, জানতে চাওয়া হলে ড. ইউনূস বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই বলতে পারবেন না। কারও সঙ্গে তাঁর কথা হয়নি। তবে তাঁর ভারতে থেকে যাওয়াটা ঠিক হবে না।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সম্ভাব্য প্রধান বলেন, বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রী হলে দেশের সংখ্যালঘুরাও নিরাপদে থাকবেন। তাঁদের বক্তব্য প্রাধান্য পাবে। গুরুত্ব পাবে। গ্রাহ্য হবে। সংখ্যালঘুরা ভোট দিতে পারবেন। নিজেদের প্রতিনিধি নিজেরাই বেছে নিতে পারবেন।
Share this content:
Post Comment