হাসিনা-রেহানাদের আরো ৪ আলিশান বাগানবাড়ি সন্ধান

- রূপপুর দুর্নীতির টাকায় টিউলিপের লন্ডনের ফ্ল্যাট?
- ডুপ্লেক্স ভবন, শানবাঁধানো ঘাট, সুইমিংপুল আরও কত কি!
ঢাকা অফিস- জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। সে সময় তার সঙ্গে ছিলেন শেখ রেহানা। এই দুই বোনের পরিবারের সদস্যরা বিদেশে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের কী কী সম্পদ আছে, তা খোঁজ করছে। সংস্থাটি তথ্য চেয়ে গাজীপুর জেলা প্রশাসনকে চিঠিও দিয়েছে।
তাদের সম্পদের খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়,শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানার পরিবারের অধীনে গাজীপুরে রয়েছে ৪টি বাগানবাড়ি, যেগুলোর মধ্যে কিছু পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এ বাগানবাড়িগুলোর একটিতে গত ৫ আগস্ট ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বর্তমানে স্থানীয় প্রশাসন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব সম্পত্তি নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে।
বাগানবাড়িগুলোর মধ্যে একটি হল ‘টিউলিপ’স টেরিটরি’, যা গাজীপুরের কানাইয়ায় অবস্থিত। এটি শেখ রেহানার স্বামী শফিক আহমেদ সিদ্দিকের মালিকানাধীন। প্রায় ৮ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই বাগানবাড়িটি গ্রামীণ পরিবেশে সজ্জিত, যেখানে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি, শানবাঁধানো ঘাট ও পুকুর রয়েছে। বাড়িটি বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে এবং সেখানে ভাঙচুরের চিহ্ন দেখা যায়। স্থানীয়রা জানান, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর একটি দল বাগানবাড়িটিতে হামলা চালায় এবং ধ্বংস করে ফেলে।
শেখ রেহানার স্বামী শফিক আহমেদ সিদ্দিকের মালিকানাধীন এই বাগানবাড়ি ছাড়াও গাজীপুরে আরও তিনটি বাগানবাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে। সেগুলোর মধ্যে একটি ‘তেলিরচালা’ এলাকায়, আরেকটি ‘ফাওকাল’ এলাকায় এবং একটি ‘বাঙ্গালগাছ’ এলাকায়। স্থানীয় ভূমি কার্যালয়ের নথি অনুযায়ী, এই বাড়িগুলোর জমির পরিমাণ প্রায় ২৫ বিঘা, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, জমির পরিমাণ আরও বেশি।
বাগানবাড়ি গুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো ‘তেলিরচালা’ বাগানবাড়ি। এটি শিল্পাঞ্চলীয় এলাকাতে অবস্থিত এবং এখানে একটি ডুপ্লেক্স ভবন, সুইমিংপুল, পুকুর ও খোলা জায়গা রয়েছে। ৫ আগস্ট এখানে ও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল এবং বাড়িটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে।
এছাড়া ‘ফাওকাল’ বাগানবাড়ি, যেখানে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি এবং বিশাল পুকুর রয়েছে, তাতেও ভাঙচুরের চিহ্ন রয়েছে। বাগানবাড়িটির মালিকের নাম তারিক আহমেদ সিদ্দিক, যিনি শেখ রেহানার দেবর।
আরেকটি বাগানবাড়ি ‘বাঙ্গালগাছ’ এলাকার ‘বাগানবিলাস’। এটি কিছুটা ভিন্ন, এখানে শত শত গাছ লাগানো এবং একটি পুকুর রয়েছে। স্থানীয়রা জানায়, এখানে অনেক বছর ধরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। তবে ৫ আগস্ট এখানে ভাঙচুরের পর থেকে বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।
এছাড়া, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পত্তি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে। সংস্থা ইতোমধ্যে গাজীপুর জেলা প্রশাসনকে জমির তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে এবং প্রতিবেদন সংগ্রহের কাজ চলছে।
শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের বেশির ভাগের নামে ৫ আগস্টের পর হত্যা মামলা হয়েছে। দুদক তাঁদের দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলাও হয়েছে।
দুদক গত ১৭ ডিসেম্বর ৯ প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ ও টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। সংস্থাটি তথ্য গোপন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ঢাকার পূর্বাচলে ৬০ বিঘা আয়তনের ৬টি প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তাঁদের পরিবারের ছয়জনের বিরুদ্ধে গত ১৩ ও ১৪ জানুয়ারি দুটি মামলা করে। তিন বিমানবন্দরে চার প্রকল্পে ৮১২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তারিক আহমেদ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গত ২৭ জানুয়ারি চারটি মামলা করেছে দুদক।
দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ পৈতৃক সূত্রে ও লিখে দেওয়া সূত্রে জমি পেয়েছেন। শেখ হাসিনা হলফনামায় জমি দেখিয়েছেন। কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যদের সম্পদ সংগ্রহের বিষয়ে আরও তদন্ত প্রক্রিয়া চলছে।
এই চারটি বাগানবাড়ি এবং সম্পত্তি সম্পর্কে দুর্নীতি দমন কমিশন বিস্তারিত তদন্ত করছে এবং কিছু মামলার ক্ষেত্রেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
রূপপুর দুর্নীতির টাকায় টিউলিপের লন্ডনের ফ্ল্যাট?
ব্রিটিশ এমপি ও শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের মালিকানাধীন ৭ লাখ পাউন্ডের লন্ডনের একটি ফ্ল্যাটের উৎস নিয়ে তদন্ত চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার করা টাকার একটি অংশ দিয়ে সেটি কেনা হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতি ঢাকতে সেটি উপহার পাওয়ার নাটক সাজায় শেখ পরিবার।
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ তদন্ত করছে। দেশের বৃহত্তম অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর একটির সাথে যুক্ত তহবিল ব্যবহার করে টিউলিপ লন্ডনের সম্পত্তি কিনেছিলেন কি না, সে প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা করছে দুদক। দ্য টেলিগ্রাফ এমন তথ্য জানায়।
তদন্তের এক আপডেটে দুদক বলেছে, তারা অভিযোগ পেয়েছে যে টিউলিপ সিদ্দিক লন্ডনে ৭০০,০০০ পাউন্ডের একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট পেয়েছেন। ফ্ল্যাটটি বাংলাদেশের ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলারের (১০.১ বিলিয়ন পাউন্ড) রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আত্মসাৎ করা অর্থের একটি অংশ দিয়ে কেনা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
তদন্তকারীরা দাবি করেছেন, হাসিনার ঘনিষ্ঠ মহলের সদস্যদের জন্য উচ্চমূল্যের সম্পত্তি অর্জনের আগে মালয়েশিয়ার অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ পাচার করা হয়। এরপর সেটি বিভিন্ন চ্যানেল ঘুরে লন্ডনে পাঠানো হয়।
দুদকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা দ্য টেলিগ্রাফকে বলেছেন, আমাদের গোপন তদন্তে এই অভিযোগগুলো নিশ্চিত হওয়ার পর, আমরা এটির একটি প্রকাশ্য তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি (টিউলিপ) দুর্নীতি এবং আর্থিক অসদাচরণের অভিযোগে জড়িত। আমরা অভিযোগ পেয়েছি, তিনি বাংলাদেশে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে যুক্ত অর্থ পাচার এবং অবৈধ আর্থিক লেনদেনের সাথে জড়িত ছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির মাধ্যমে টিউলিপ ও তার পরিবারের সদস্যরা ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাৎ করেছেন। এ প্রকল্পের ৯০ শতাংশ ঋণ এসেছে ক্রেমলিন থেকে, আর দায়িত্বে আছে রাশিয়ান কোম্পানি রোসাটম। এর সূত্র ধরে টিউলিপের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে লন্ডনে বিনামূল্যে ফ্ল্যাট পেয়েছেন কি না সেটিই এখন তদন্তে গুরুত্ব পাচ্ছে।
বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে যুক্তরাজ্যে বিপাকে পড়েন টিউলিপ সিদ্দিক। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা এবং তদন্তের মুখে ১৪ জানুয়ারি মন্ত্রিত্ব ছাড়েন তিনি। গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনার সরকারের পতনের পর শেখ পরিবারের দুর্নীতির সঙ্গে টিউলিপের নাম ব্যাপকভাকে আলোচিত হলেও তার যোগসাজশ ছিল বেশ পুরোনো।
আওয়ামী লীগ সরকার ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে ফ্ল্যাট নেওয়া, শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনে সহযোগিতা, অন্তঃসত্ত্বা সাংবাদিককে হুমকি, ব্যারিস্টার আরমানের স্ত্রীকে হেনস্থা করানো বা পূর্বাচলে প্লট জালিয়াতি ছাপিয়ে টিউলিপের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ ছিল- রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে টাকা আত্মসাতের মধ্যস্থতা করা।
এ প্রকল্প থেকে ৫০০ কোটি ডলার (বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৯ হাজার কোটি টাকা) আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮ আগস্ট গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের এক প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্য জানা যায়।
এতে বলা হয়, রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা-রোসাট্রম মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে এ অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দেয়। যাতে মধ্যস্থতা করেন ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিক।
গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রাশিয়ার সহযোগিতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণে খরচ ধরা হয় ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার। প্রয়োজনের তুলনায় যা অনেক বেশি। যাতে মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে এই বাজেট থেকে ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাতের সুযোগ করে দেয় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা-রোসাট্রম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিজের ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকের মধ্যস্থতায় রাশিয়ার সঙ্গে এ চুক্তি করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এ মধ্যস্থতার বিনিময়ে পাচার করা অর্থের ৩০ শতাংশ পেয়েছেন টিউলিপ, শেখ রেহানা ও পরিবারের কয়েকজন সদস্য।
২০১৩ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সাক্ষাতের সময় সঙ্গী ছিলেন টিউলিপ সিদ্দিক। গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের দাবি, সে সময় ঢাকা-মস্কোর বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তির মধ্যস্থতাও করেন তিনি।
এদিকে যুক্তরাজ্যের সাবেক সিটি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত করছে দেশটির ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির (এনসিএ) গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সঙ্গে সম্প্রতি ঢাকায় এক গোপন বৈঠকের পর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এ তথ্য দেয় বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল।
টিউলিপের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি প্রমাণ হলে তার ১০ বছরের জেল হতে পারে। কারণ, ব্রিটেনের ব্রাইবারি অ্যাক্ট ২০১০ অনুযায়ী, কেউ বিদেশে ঘুষ গ্রহণ করলে তার বিরুদ্ধে ব্রিটেনে মামলা এবং সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড হতে পারে।
Share this content:
Post Comment