শামসুল ইসলাম, ১১ মার্চ: বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের ১২৪ অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে দুদক। মঙ্গলবার দুদকের একটি সূত্র সুরমা’কে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। শেখ হাসিনা ও তার পরিবার এবং তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ফ্রিজিং করা ১২৪ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৬৩৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা পেয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এছাড়া, ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা দলিলমূল্যে রাজউকের ৬০ কাঠা প্লট এবং ৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা মূল্যের ১০ শতাংশ জমিসহ আটটি ফ্ল্যাট অবরুদ্ধ করেছে বিএফআইইউ।
সোমবার (১০ মার্চ) প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত 'পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার, গৃহীত পদক্ষেপ ও চ্যালেঞ্জ'- শীর্ষক উচ্চ পর্যায়ের সভায় এসব তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের প্রেস উইং তা প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা, তার পরিবার ও তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং এবং কেম্যান দ্বীপপুঞ্জে সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়া মালয়েশিয়ার একটি অ্যাকাউন্টে রাশিয়ান 'স্লাশ ফান্ড' এর অস্তিত্বও পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এতে।
হাসিনা পরিবার ও তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে দায়ের হওয়া ৬টি মামলার তদন্ত শেষে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে এবং পরিবারের ৭ সদস্যকে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সভায় আরও জানানো হয়, ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা দলিল মূল্যে রাজউকের ৬০ কাঠা প্লট এবং ৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা মূল্যের ১০ শতাংশ জমিসহ আটটি ফ্ল্যাট অবরুদ্ধ করেছে বিএফআইইউ। অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে যে ১১টি অর্থপাচারের মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এসব মামলার মধ্যে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অর্থ পাচার মামলা এক নম্বরে রয়েছে। শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সাত সদস্যসহ রাজউক ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ছয় মামলার অভিযোগপত্রে অনুমোদন দিয়েছে কমিশন।
‘ভুয়া’ নোটারিতে বোনকে গুলশানের ফ্ল্যাট দেন টিউলিপ
পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি, ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক তার বোনকে গুলশানের একটি ফ্ল্যাট হস্তান্তরে যে নোটারি ব্যবহার করেছেন, তদন্তে তা ‘ভুয়া’ প্রমাণিত হওয়ার তথ্য দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক বলছে, শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে করা একটি মামলার তদন্তে নেমে তারা এ তথ্য পেয়েছে। গত ১৩ জানুয়ারি টিউলিপের মা শেখ রেহানা, ভাই রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও বোন আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীর বিরুদ্ধে আলাদা মামলা করে দুদক। এসব মামলায় শেখ হাসিনা এবং যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রতিমন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিককেও আসামি করা হয়। এর মধ্যে রূপন্তীর বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্তে নেমে ‘ভুয়া নোটারি’ ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়ার কথা বলছে দুদক। এ মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে আছেন দুদকের সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া। দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে, হেবা দলিলটি হয় ২০১৫ সালের ৯ জুন। সেখানে দাতা ছিলেন রিজওয়ানা সিদ্দিক (টিউলিপ সিদ্দিক); গ্রহীতা ছিলেন আজমিনা সিদ্দিক। দলিলে বলা হয়, ‘বোনের প্রতি ভালবাসা ও স্নেহ‘থেকে সম্পত্তি হেবা দিতে চান দাতা। দলিল অনুযায়ী, ২৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকায় কেনা গুলশানের ফ্ল্যাটটি আজমিনা সিদ্দিককে দেওয়া হয়। দলিলে ফ্ল্যাটের সম্পূর্ণ মালিকানা, স্বত্ব, অধিকার এবং একটি পার্কিং স্পেস হস্তান্তরের কথা বলা রয়েছে।
দলিল অনুযায়ী ফ্ল্যাটের অবস্থান, গুলশান রেসিডেনশিয়াল মডেল টাউনের ১১ নম্বর প্লটে। এটি ভবনের দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ-পূর্ব পাশের একটি ফ্ল্যাট। দুজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে দলিল সম্পন্ন হয়। হেবা দলিলে সই রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গাজী সিরাজুল ইসলামের। প্লট মামলার অভিযোগ তদন্তে দুদক ওই আইনজীবীরও সাক্ষ্য নেয়। দুদককে তিনি বলেছেন, ২০১২ সালে তিনি নোটারি লাইসেন্স পান। শুরু থেকেই তিনি শুধু নিজের চেম্বারের কাগজ নোটারি করেন। তার নোটারির নামে যে হেবা দলিলটি দেখানো হয়েছে, সেখানে সিলটি তার মতই, কিন্তু সইটি ‘তার নয়’। হেবা দলিলের এক সাক্ষীকে চিনলেও দাতাসহ অন্যদের চেনেননা বলে দুদকের কাছে দাবি করেছেন ওই আইনজীবী। তিনি বলেন, “ওই হেবা দলিলের নোটারি আমি করিনি। উনাদের কখনো ওই নামে চিনিও না। এমনিতে চিনি ওই নামে একজন ব্রিটিশ মন্ত্রী ছিলেন কিছুদিন আগে; ওতটুকুই। “কিন্তু উনাদের আমি চিনি না। আর বিষয় হল, আমি আমার চেম্বারের বাইরে সাধারণত কোনো নোটারি করি না।'' এই আইনজীবী বলেন, “আমি বাণিজ্যিক ভিত্তিতেও কোনো নোটারি করি না। যদি কাউকে আমি না চিনি, তাদের ক্ষেত্রেও করি না।”
ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মের মাধ্যমে রাজউকের প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে সম্প্রতি শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সাত সদস্যের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করে দুদক। এসব মামলায় রাজউক ও সরকারের একাধিক কর্মকর্তাকেও আসামি করা হয়। সোমবার এসব মামলায় অভিযোগপত্র অনুমোদন দেওয়া হয়েছে জানিয়ে দুদক মহাপরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, “শিগগিরই সেগুলো আদালতে দাখিল করা হবে।” এর মধ্যে একটি অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা নিজে ও সন্তানের নামে প্লট নিচ্ছেন—এ তথ্য জানার পর বোন আজমিনা সিদ্দিকের জন্যও প্লট নিতে উদ্যোগী হন টিউলিপ। দুদক বলছে, প্রধানমন্ত্রীর ভাগ্নি হওয়ার সুবাদে ‘অবৈধ প্রভাব’ কাজে লাগিয়ে টিউলিপ নিজের জন্য বা অন্য কাউকে ‘সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার’ অপরাধে জড়িত হন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, তিনি ‘নিয়ম বহির্ভূতভাবে’ গুলশানের একটি ফ্ল্যাটের মালিকানা অর্জন করেন, যা প্লট বরাদ্দ আইন ও নীতিমালা অনুযায়ী তাকে পূর্বাচল প্রকল্পের প্লট পেতে অযোগ্য করে তোলে। এ কারণে তিনি ‘জালিয়াতি করে’ ছোট বোন আজমিনা সিদ্দিকের নামে ভুয়া নোটারিতে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করেন। আয়কর নথিতে ২০১৫ সালের পর থেকে এই ফ্ল্যাটের তথ্যও ‘গোপন’ করেন। দুদক বলছে, আজমিনা সিদ্দিকও পূর্বাচল প্রকল্পের প্লট পাওয়ার যোগ্য ছিলেন না। তাই তিনি ফ্ল্যাটটির মালিকানা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ না করে বাস্তব দখল নেন, যেন প্লট বরাদ্দের সুযোগ পাওয়া যায়। প্লট বরাদ্দের অনিয়মের এসব মামলায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকার, সিনিয়র সহকারী সচিব পুরবী গোলদার, অতিরিক্ত সচিব অলিউল্লাহ ও সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিনকে আসামি করা হয়েছে। রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা, সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, তন্ময় দাস, মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, মেজর (অব.) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী, মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, মাজহারুল ইসলাম, মো. কামরুল ইসলাম, নায়েব আলী শরীফ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন এবং সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদও আসামির তালিকা আছেন।
কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ ও পাঁচ দেশে শেখ হাসিনা পরিবারের সম্পদের খোঁজ
কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ ও ৫টি দেশে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ৬৩৫ কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। প্রেস সচিব বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং এবং কেম্যান দ্বীপপুঞ্জে হাসিনার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। ১২৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৬৩৫ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, রাজউকের ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্যের ৬০ কাঠা প্লট পাওয়া গেছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের নামে। এ ছাড়া ৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকার ১০ শতাংশ জমিসহ ৮টি ফ্ল্যাট পাওয়া গেছে।
এ সময় শফিকুল আলম বলেন, অনেক ছেলেমেয়ে বিদেশে পড়ালেখা করতে যায়। এক ঘটনায় দেখা গেছে, ছেলের একটি সেমিস্টারের টিউশন ফি হিসেবে ৪০০ কোটি টাকা বিদেশে পাঠানো হয়েছে। সকালে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে টাস্কফোর্সের সভায় এ তথ্য জানিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান। প্রেস সচিব বলেন, মানিলন্ডারিংটা কীভাবে হয়েছে দেখেন। তবে তদন্তের স্বার্থে ব্যক্তির নাম প্রকাশ করছি না আমরা। কতটা ইনোভেটিভ প্রক্রিয়ায় টাকা পাচার হয়েছে। আমরা জানতাম ওভার ইনভয়েসিং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে, ব্যাংকিং সিস্টেমে বা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা চলে গেছে। কিন্তু দেখা গেছে, কিছু কিছু জায়গায় লুপ হোল খুঁজে ৪০০ কোটি…। পৃথিবীতে কারও টিউশন ফি ৪০০-৫০০ কোটি টাকা আছে?
তিনি বলেন, পাচার করা টাকা উদ্ধারের জন্য প্রথম থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার তৎপর ছিল। প্রফেসর ইউনূস প্রথম থেকেই বলে আসছেন যে এটা বাংলাদেশের মানুষের টাকা। আমাদের টপ প্রায়োরিটির ভেতরে এটা থাকবে। অন্তর্বর্তী সরকারের ফোকাস ছিল পাচার করা টাকা কীভাবে আনা যায়। সেজন্য গত সেপ্টেম্বর মাসে ১১ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেন্ট্রাল ব্যাংকের গভর্নর। প্রেস সচিব বলেন, টাকাটা ফেরত আনার প্রচেষ্টা কতদূর এগোল, সেটার ওপর আজ একটা বড় মিটিং হয়েছে। মিটিংয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা। সেই মিটিংয়ে অনেক সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাচার করা টাকা কীভাবে আনা যায়, সেটি ত্বরান্বিত করার জন্য একটা বিশেষ আইন খুব শিগগিরই করা হবে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে আপনারা এই আইনটা দেখবেন।