সেনাবাহিনী নিয়ে তুর্কের মন্তব্য ও ইন্ডিয়ান মিডিয়ার প্রপাগান্ডার প্রতিক্রিয়া জানালো আইএসপিআর

মিনহাজুল আলম মামুন, ১৩ মার্চ: জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের মন্তব্যে ও ইন্ডিয়ান মিডিয়ার প্রপাগান্ডার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।
১০ মার্চ, সোমবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ভলকার তুর্কের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়- ঢাকা, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সাক্ষাৎকার ভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘হার্ডটক’ এ গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের মন্তব্য নিয়ে একটি সংবাদ প্রচার করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মানবাধিকারের তাৎপর্য যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে এবং যেকোনো গঠনমূলক সমালোচনা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে, তবে অধিকতর সঠিকতা ও স্বচ্ছতার উদ্দেশ্যে উক্ত মন্তব্যের কিছু বিষয়ে স্পষ্টিকরণ প্রয়োজন বলে মনে করে।
এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার থেকে এ বিষয়ক কোনো ইঙ্গিত কিংবা বার্তা সম্পর্কে অবগত নয়। যদি এ সংক্রান্ত কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়ে থাকে, তবে তা তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হয়ে থাকতে পারে, সেনাবাহিনীকে নয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতীয় নিরাপত্তা নির্দেশিকা অনুযায়ী কাজ করে এবং সর্বদা আইনের শাসন ও মানবাধিকার নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে, ভলকার তুর্কের মন্তব্য কিছু মহলের মাধ্যমে ভুলভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে, যা সেনাবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি এবং এর পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
নিরপেক্ষতা ও সততার মহান ঐতিহ্য ধারণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বদা জনগণের পাশে থাকতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অতীতের ঘটনাপ্রবাহ, বিশেষত ১৯৯১ সালের গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রমাণ করে যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কখনো জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করেনি। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময়ও সেনাবাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং কোনো পক্ষপাত বা বাহ্যিক প্রভাব ছাড়াই জননিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। প্রসঙ্গত, বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে, পেশাদারিত্ব ও নিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এখানে উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অর্জিত আয়ের একটি ক্ষুদ্র অংশ শান্তিরক্ষীরা পেয়ে থাকেন এবং এর সিংহভাগ জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে, যার পরিমাণ গত ২৩ বছরে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ককে গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করে এবং দেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব পালনে সর্বদা অঙ্গীকারবদ্ধ। সেনাবাহিনীর ভূমিকা সংক্রান্ত যেকোন বিষয়ে উদ্বেগ অথবা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলে তা গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে ফলপ্রসুভাবে সমাধান করা সম্ভব বলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মনে করে।
১০ মার্চ, মঙ্গলবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে পাঠানো আরেক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দ্য ইকোনমিক টাইমস এবং ইন্ডিয়া টুডেতে, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা এবং কমান্ড চেইনে বিচ্ছিন্নতা শীর্ষক প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়েছে। আইএসপিআর বলেছে, দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার নীতি মেনে চলার পরিবর্তে ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ে বারবার বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা চালাচ্ছে এবং ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। আইএসপিআরের সহকারী পরিচালক রাশেদুল আলম খান স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবাদলিপিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করেছে যে কিছু ভারতীয় গণমাধ্যম , যার মধ্যে দ্য ইকোনমিক টাইমস এবং ইন্ডিয়া টুডে অন্তর্ভুক্ত, সম্প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা এবং কমান্ড চেইনে বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে একের পর এক ভিত্তিহীন ও অপ্রমাণিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনগুলি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং এটি একটি ইচ্ছাকৃত ভুল তথ্য প্রচার অভিযানের অংশ বলে মনে হচ্ছে, যার লক্ষ্য বাংলাদেশ ও তার সশস্ত্র বাহিনীর স্থিতিশীলতা এবং সুনামকে ক্ষুণ্ন করা।
আমরা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছি যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ এবং সেনাপ্রধানের দক্ষ নেতৃত্বে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কমান্ড চেইন অত্যন্ত মজবুত, এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সকল সদস্য, যার মধ্যে সিনিয়র জেনারেলরাও অন্তর্ভুক্ত, সংবিধান, কমান্ড চেইন এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তাদের আনুগত্যে অটল। র্যাংকগুলোর মধ্যে কোনও বিভক্তি বা অবিশ্বাসের অভিযোগ সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং দূষিত।
এটি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক যে দ্য ইকোনমিক টাইমস বারবার এই ধরনের ভুল তথ্য প্রচার অভিযানে জড়িত হয়েছে। একই গণমাধ্যম দ্বারা ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে, মাত্র এক মাস আগে, একই ধরনের মিথ্যা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। এই ধরনের আচরণের ধারা এই মিডিয়া আউটলেটগুলির উদ্দেশ্য এবং বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে। তদুপরি, বেশ কয়েকটি অনলাইন পোর্টাল এবং কিছু নোংরা ও তথাকথিত টেলিভিশন চ্যানেলও এই মিথ্যাগুলি প্রচার করেছে। এসব মিডিয়া দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার নীতিগুলি মেনে চলার পরিবর্তে, তারা ভুল তথ্য ছড়ানো এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টির হাতিয়ার হিসাবে কাজ করছে বলে বাংলাদেশ সেনা বাহিনী মনে করছে।
আমরা এই মিডিয়া আউটলেটগুলিকে, বিশেষ করে যেগুলি ভারতভিত্তিক, ভাল সাংবাদিকতা অনুশীলন মেনে চলার এবং অযাচিত ও সেন্সেশনালিস্ট গল্প প্রকাশ থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করছি। এই ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশের আগে তাদের ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্স (আইএসপিআর) থেকে মন্তব্য এবং স্পষ্টীকরণ চাওয়া উচিত। আইএসপিআর সবসময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে সঠিক এবং সরকারী তথ্য প্রদানের জন্য দায়বদ্ধ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতীয় সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা এবং নিরাপত্তা রক্ষায় তার প্রতিশ্রুতিতে অবিচল রয়েছে। আমরা সকল মিডিয়া আউটলেটকে দায়িত্বশীলভাবে কাজ করার এবং মিথ্যা বিবৃতি ছড়ানো থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাই, যা শুধুমাত্র অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।
Share this content:
Post Comment