শেখ হাসিনার কথাই ছিলো আইন

ঢাকা অফিস, ১৬ মার্চ: আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার কথাই ছিল আইন। এ আইন লঙ্ঘনের সাধ্য ছিল না কারও। অগত্যা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে শেখ হাসিনাকে সন্তুষ্ট রেখেই সবাইকে চলতে হতো। যদি কেউ এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাতেন, শেখ হাসিনার কাজকর্মের সমালোচনা কিংবা বিরুদ্ধাচরণ করতেন, তৎক্ষণাৎ তার ওপর খক্ষ নেমে আসত। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, ড. কামাল হোসেন, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, তার ছোট ভাই বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল জলিল, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান থেকে শুরু করে তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ। প্রবীণ থেকে শুরু করে নবীন নেতারা-কেউই শেখ হাসিনার এই খক্ষের হাত থেকে রক্ষা পাননি। কথায় কথায় শেখ হাসিনা তাদের অপমান-অপদস্ত করতেন। বাধ্য করতেন দল ছেড়ে দিতে। তোফায়েল আহমেদের মতো অনেক প্রবীণ নেতা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে থাকলেও তারা ছিলেন শেখ হাসিনার এক ধরনের করুণার জালে বন্দি। আওয়ামী লীগের ভেতরে মর্যাদা বলে তাদের ছিল না কিছুই।  এমন মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ ছেড়ে যাওয়া কয়েকজন প্রবীণ নেতা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সত্য কথা বলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধাচরণ করে কেউ দলে টিকতে পারেননি। এছাড়া ক্ষমতায় থাকার সময় শেখ হাসিনা স্বৈরাচারী কায়দায় যেমন দেশ চালাতেন, তেমনি একই কায়দায় চালাতেন দলও। কারও কথা তিনি শুনতেন না, আমলে নিতেন না। নিজে যা ভালো মনে করতেন তাই করতেন। তার সিদ্ধান্তই সবাইকে মাথা পেতে মেনে নিতে হতো। অনেকটা হিটলারের মতো শেখ হাসিনাও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একনায়ক হয়ে উঠেছিলেন। ছোট বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ রেহানার ছেলে ববি সিদ্দিকীসহ পরিবারের সদস্যরাই ছিল তার কাছে সব। আওয়ামী লীগের ত্যাগী এবং পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করে, জেল-জুলুম খেটে, নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়ে, জীবন বিসর্জন দিয়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসালেও, তিনি কখনো তাদের সেভাবে মূল্যায়ন করেননি। বরং দলে এবং সরকারে-সর্বত্র পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। শুধু তাই নয়, ক্ষমতার প্রতি মোহগ্রস্ত পতিত এই স্বৈরাচার সব সময় চাটুকার দ্বারা বেষ্টিত থাকতে পছন্দ করতেন। এতটাই দাম্ভিক এবং অহংকারী ছিলেন যে ভিন্নমত তিনি কোনোভাবে মানতে পারতেন না। নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের জন্য অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে চিহ্নিত অপরাধী, মাফিয়া, গডফাদার, দুর্নীতিবাজ, লুটেরা এবং হাইব্রিডদের দলে ভেড়াতেন, কাছে টানতেন। শেখ হাসিনা চাটুকারিতা এতটাই পছন্দ করতেন যে বিভিন্ন সময়ে সংবাদ সম্মেলনে যারা তাকে তৈলাক্ত প্রশ্ন করতেন, তাদের নিমিষেই ভাগ্য বদলিয়ে দিতেন। বিশ্লেষকদের মতে, একনায়কতন্ত্র, হাইব্রিড আর চাটুকারে ডুবেছে আওয়ামী লীগ। আর পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা নিজের এবং দলের কার্যত কবর রচনা করে গেছেন।

এ প্রসঙ্গে এক সময়কার আওয়ামী লীগ নেতা, প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগের এই পরিণতির জন্য এককভাবে শেখ হাসিনাই দায়ী। তিনি ত্যাগী এবং পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের উপেক্ষা করেছেন। অবমূল্যায়ন করতেন। অপমান-অপদস্ত করতেন। দলে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার কথাই ছিল শেষ কথা। তার কথাই ছিল আইন। তিনি নিজেকে রাজা ভাবতেন, আর দেশের মানুষকে ভাবতেন প্রজা। ভিন্নমত একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না শেখ হাসিনা। আর এ কারণেই তাকে এভাবে চোরের মতো পালাতে হয়েছে। একই অভিমত এক সময়ের তুখোড় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতা, বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানের। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা অত্যন্ত দাম্ভিক এবং অহংকারী মহিলা। তিনি কান কথা শুনতেন, চাটুকারিতা পছন্দ করতেন। নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের জন্য অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে চিহ্নিত অপরাধী, মাফিয়া, গডফাদার, দুর্নীতিবাজ, লুটেরা এবং হাইব্রিডদের দলে ভেড়াতেন, কাছে টানতেন। তার কারণেই আজ আওয়ামী লীগের এই দুরবস্থা।

শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলায় আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে ২০২৪ সালের ২৪ অক্টোবর আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর আগে একইভাবে ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয় তার ছোট ভাই, বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীকেও। আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। ছিলেন পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী। সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে কথা বলার অপরাধে দল থেকে ছিটকে পড়েন, মন্ত্রিত্বও হারান। আর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী ছিলেন দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির এক নম্বর সদস্য। তাকে বাদ দিয়ে শেখ হাসিনা তার আপন ফুফাতো ভাই আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহকে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির এক নম্বর সদস্য করেন।

শেখ হাসিনার বিরাগভাজন হয়ে ছাত্রলীগের এক সময়কার তুখোড় নেতা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানকেও আওয়ামী লীগ ছাড়তে হয়। শেখ হাসিনাকে তোষামোদি করতে না পারায় আমৃত্যু দলে উপেক্ষিত ছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন। তাদের সন্তান তানজিম আহমদ সোহেল তাজও শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ করতে পারেননি। শেখ হাসিনার আরেক ফুপাতো ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিমসহ শেখ পরিবারের অনেকে পরোক্ষভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করতেন। সোহেল তাজ এর বিরোধিতা করলে শেখ সেলিমের সঙ্গে তুমুল বিরোধ জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু শেখ হাসিনা সঠিক প্রতিকার না করায় শেষ পর্যন্ত ক্ষোভ আর অভিমানে দল ছাড়েন নবীন এই নেতা। তাজউদ্দীন আহমদ এবং সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন আমৃত্যু উপেক্ষিত ছিলেন আওয়ামী লীগে। শেখ হাসিনাও কখনোই তাদের অবদান স্বীকার করেননি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। দলটির দীর্ঘ ইতিহাসে এই দুজনের বাইরেও অনেকে বিভিন্ন সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন। পালন করেছেন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। কিন্তু শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর কখনোই এসব নেতাদের অবদান স্বীকার করেননি। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হকসহ দলীয় উদ্যোগে কোনো নেতারই জন্মদিন কিংবা মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেনি আওয়ামী লীগ। মূলত শেখ হাসিনা নিজেই চাননি। তিনি চাইতেন, তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানকেই সব কৃতিত্ব দিতে। প্রথম মেয়াদের ৫ বছর এবং পরের মেয়াদে টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসন আমলে শেখ হাসিনা তার নিজের এবং বাবা-মা, ভাই-বোন ও আত্মীয়স্বজনের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেন। কিন্তু ওইসব জাতীয় নেতাদের নামে তিনি কিছুই করেননি। মূলত সব ক্ষেত্রে নিজের বাবা-মা, ভাই-বোন এবং আত্মীয়স্বজনকে টেনে এনে আওয়ামী লীগকে একটি পরিবার নির্ভর রাজনৈতিক দলে পরিণত করেন তিনি। ফলে পরিবারতন্ত্র ও আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হওয়ার কারণে শেখ হাসিনা ক্ষমতার ১৫ বছর পর জনরোষে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। এভাবে প্রতিহিংসাপরায়ণ এই স্বৈরশাসক শুধু একাই ধ্বংস হননি, সেইসঙ্গে দলের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে অতল গভীরে ডুবিয়ে দিয়েছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, দলের প্রয়োজনে এবং নেতাকর্মীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আজ থেকে ৪৪ বছর আগে দিল্লি থেকে শেখ হাসিনা দেশে ফিরেছিলেন অনেকটা দলের ত্রাণকর্তা হিসাবে। অথচ এই দীর্ঘ সময় পর এবার শেখ হাসিনাকে সেই দিল্লি পালাতে হলো রীতিমতো চোর ও পলাতক আসামির মতো।

Share this content:

Post Comment

অন্যান্য