লুটেরাদের প্রধান টার্গেট ছিল দেশের সুসংহত ব্যাংক খাত

ঢাকা অফিস: পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লুটেরাদের প্রধান টার্গেট ছিল দেশের সুসংহত ব্যাংক খাত। বন্দুকের নলের মাধ্যমে দেশের সেরা ব্যাংকগুলো দখল করে নেয়া হয়। এ লুটপাটের জন্য এস আলম গ্রুপের প্রধান সাইফুল আলম, এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, বেক্সিমকোর সালমান এফ রহমানসহ একটি অলিগার্ক শ্রেণী গড়ে তোলা হয়। যাদের মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা বের করে নেয়া হয়। আর সাধারণের আমানতের লুটপাটের ভাগিদার হয় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি থেকে শুরু করে শেখ পরিবারের সদস্যরা। ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে চরম অস্থিরতা শুরু হয়। এখনো অনেক ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হলেও তা পর্যাপ্ত হচ্ছে না।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময় অনেক দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে এসেছিল। বিশ্বের অনেক নামীদামি ব্যাংকও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল বাংলাদেশ। ব্যাংক খাত শক্তভিত্তির ওপর গড়ে ওঠায় ওই সময় দেশের অর্থনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। কিন্তু সেই সুসংহত ব্যাংক খাত ক্রমেই দুর্বল হতে থাকে। প্রথমে হলমার্ক, বেসিক ব্যাংকের মতো ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। বড় লুটপাটের জন্য ২০১৭ সালের পর বেছে বেছে দেশের ভালো ব্যাংকগুলোর মালিকানা বন্দুকের নলের মাধ্যমে তুলে দেয়া হয় এস আলম নামক এক বিতর্কিত ব্যবসায়ীর হাতে। এর পর থেকেই দেশের ব্যাংক খাতে মহালুটপাট শুরু হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এস আলমের মাধ্যমে শুধু ১১ ব্যাংক থেকেই বের করে নেয়া হয় প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৯৭ হাজার কোটি টাকাই নগদ বের করে নেয়া হয়। এভাবে এস আলমের মতো নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, বেক্সিমকোর সালমান এফ রহমান, সামিট গ্রুপসহ একধরনের অলিগার্ক শ্রেণী গড়ে তোলা হয়, যাদের মাধ্যমে লুটপাট করা হয় দেশের ব্যাংকিং খাতের লাখ লাখ কোটি টাকা।

একসময় এশিয়া মহাদেশের মতো অন্যতম বৃহৎ ব্যাংকের তালিকায় ছিল দেশের ইসলামী ব্যাংক। ২০১৭ সালে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও এমডিকে বন্দুকের নলের মুখে বের করে দেয়া হয়। ব্যাংকটির প্রায় পুরো মালিকানা নিয়ে নেয় এস আলম। এরপর বৃহৎ এ ব্যাংক থেকে পানির মতো টাকা বের করে নেয় এস আলম। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৭ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম বের করে নেয় এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এভাবে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও সর্বশেষ ন্যাশনাল ব্যাংক দখলে নেয়। ইসলামী ব্যাংক ও আল-আরাফা ব্যাংক বাদে অন্য ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত অনেকটাই নড়বড় হয়ে পড়েছে। ব্যাংকগুলো সাধারণের আমানতের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য। তেমনিভাবে এক্সিম ব্যাংক থেকে নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, বেক্সিমকোর সালমান এফ রহমান আইএফআইসি ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নেয়। ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ বের করে নেয় শিকদার গ্রুপ ও এস আলম। এভাবেই দেশের সুসংহত ব্যাংকিং খাত এখন দুর্বল অবস্থানে চলে গেছে।

গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। দেশ থেকে পালিয়ে যায় পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সাথে পালিয়ে যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নিয়েই ব্যাংকগুলোর পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়। একই সাথে পাচারের অর্থ উদ্ধারের জোর প্রচেষ্টা শুরু করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংক থেকে বের করে নেয়া বেশির ভাগ অর্থই পাচার করা হয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ১১টি অলিগার্ক ব্যবসায়ী গ্রুপ ও শেখ পরিবারের পাচারকৃত অর্থের খোঁজে মাঠে কাজ করছে। ইতোমধ্যে প্রায় দুই ডজন দেশে পাচারের বিপুল পরিমাণ অর্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব অর্থ উদ্ধারের কার্যক্রম চলছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্বৈরাচার সরকারের পতন হলেও দেশের সুসংহত ব্যাংকিং খাতে যে ক্ষত সৃষ্টি করে গেছে তার রেশ দেশের অর্থনীতিকে বহু দিন ধরেই টানতে হবে।

Share this content:

Previous post

আসামের দ্বিতীয় রাজধানী হবে ডিব্রুগড়ে, রাজভবন তেজপুরে, মুখ্যসচিবের দফতর শিলচরে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা

Next post

বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিতে জমি অধিগ্রহণের অনুমতি দিল পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রিসভা

Post Comment

অন্যান্য