যৌথবাহিনীর ব্যর্থ অভিযান, বিচারিক ক্ষমতা পেলো সেনাবাহিনী
- কর্মস্থলে অনুপস্থিত ১৮৭ পুলিশ সদস্য।
- পালিয়ে যাওয়া ৯০০ বন্দী এখনো পলাতক।
- যেসব ধারা ব্যবহার করতে পারবে সেনাবাহিনী।
লণ্ডন, ১৮ সেপ্টেম্বর- গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট অবৈধ ও অনৈতিক প্রধানমন্ত্রী দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর সারাদেশে বিভিন্ন থানায় হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে ক্ষমতালোভী বিক্ষুব্ধ আওয়ামী দুর্বৃত্তরা। থানা ও ফাঁড়িতে হামলার পর অস্ত্র-গোলাবারুদ লুট করে নেয় দুর্বৃত্তরা। গত ৩ সেপ্টেম্বর অস্ত্র-গোলাবারুদ জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল। এরপর ৪ সেপ্টেম্বর থেকে লুট ও অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। যৌথবাহিনীর ১০ দিনের অভিযানে মাত্র ১৪৪ অস্ত্র উদ্ধার, মাত্র ৬৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছে।
পুলিশ সদরদপ্তর থেকে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়েছে, গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে এখন পর্যন্ত ১৪৪টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৬৪ জনকে। উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের মধ্যে আটটি রিভলভার, ৪১টি পিস্তল, ১১টি রাইফেল, ১৭টি শটগান, পাঁচটি পাইপগান, ১৯টি শুটারগান, ১০টি এলজি, ২২টি বন্দুক, একটি একে ৪৭, একটি গ্যাসগান, একটি চাইনিজ রাইফেল, একটি এয়ারগান, তিনটি এসবিবিএ, তিনটি এসএমজি ও একটি টিয়ার গ্যাস লঞ্চার।
পাঁচ শতাধিক খুনের আসামীকে ধরতে না পারায় ও যৌথবাহিনীর যৌথ অভিযানে আশানুরুপ সাফল্য না আসায় সম্প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আগামী দুই মাসের জ্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ‘দ্য কোড অব ক্রিমিন্যাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮’ এর ১২(১) ধারা অনুযায়ী দুই মাসের (৬০ দিন) জন্য এই ক্ষমতা দিয়ে মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। রাতে আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের পরিচালক লেফট্যানেন্ট কর্নেল সামি উদ দৌলা চৌধুরী গণমাধ্যমে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব জেতী প্রু স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এ ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা সারাদেশে প্রয়োগ করতে পারবেন। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সেনাবাহিনীর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ‘ফৌজদারী কার্যবিধির, ১৮৯৮’ এর ৬৪, ৬৫, ৮৩, ৮৪, ৮৬, ৯৫(২), ১০০, ১০৫, ১০৭, ১০৯, ১১০, ১২৬, ১২৭, ১২৮, ১৩০, ১৩৩ ও ১৪২ ধারার অপরাধগুলো বিবেচনায় নিতে পারবেন। প্রজ্ঞাপন জারির তারিখ থেকে পরবর্তী ৬০ দিনের জন্য এ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন সিনিয়র সহকারী সচিব জেতী।
সেনাবাহিনীর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ‘ফৌজদারী কার্যবিধির, ১৮৯৮’ এর ৬৪, ৬৫, ৮৩, ৮৪, ৮৬, ৯৫(২), ১০০, ১০৫, ১০৭, ১০৯, ১১০, ১২৬, ১২৭, ১২৮, ১৩০, ১৩৩ ও ১৪২ ধারার অপরাধগুলো বিবেচনায় নিতে পারবেন বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে।
কর্মস্থলে অনুপস্থিত ১৮৭ পুলিশ সদস্য
এখনও কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন ১৮৭ পুলিশ সদস্য। মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো পরিসংখ্যানে এ তথ্য জানা গেছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়, গত ১ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের ১৮৭ জন সদস্য কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। এর মধ্যে ডিআইজি ১ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি ৭ জন, পুলিশ সুপার দুজন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার একজন, সহকারী পুলিশ সুপার ৫ জন, পুলিশ পরিদর্শক ৫ জন, উপপরিদর্শক (এসআই) ও সার্জেন্ট ১৪ জন, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ৯ জন, নায়েক ৭ জন এবং কনস্টেবল ১৩৬ জন রয়েছেন। ১৮৭ জন পুলিশ সদস্যের মধ্যে ছুটিতে অতিবাস ৯৬ জন, কর্মস্থলে গড়হাজির ৪৯ জন, স্বেচ্ছায় চাকরি ইস্তফা দিয়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত ৩ জন। এছাড়া অন্য কারণে ৩৯ জন কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন।
পালিয়ে যাওয়া ৯০০ বন্দী এখনো পলাতক
কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন জানিয়েছেন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের পট পরিবর্তনের সময়কালে সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ক্ষয়ক্ষতি হয়। কোনো কোনো কারাগারে চালানো হয় বাইরে থেকে হামলা-ভাঙচুর। এই পরিস্থিতিতে ২ হাজারের অধিক বন্দী পালিয়ে যান। তাদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন, বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পাওয়া বন্দীসহ বিচারাধীন মামলার আসামিও আছে। এরমধ্যে এখনো ৯০০ বন্দী পলাতক রয়েছে।
মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর বকশীবাজারে অবস্থিত কারা অধিদপ্তরে কারা নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে গৃহীত ব্যবস্থাদি সম্পর্কিত ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন কারা মহাপরিদর্শক। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন জানান, কয়েকটি কারাগার থেকে গোলাবারুদ লুটের ঘটনাও ঘটে। কয়েকটি কারাগারে বন্দী পলায়নের সময় কয়েকজন বন্দীর মৃত্যুসহ অনেক কারা কর্মকর্তা এবং কারারক্ষী গুরুতর আহত হন। অগ্নিসংযোগ এবং ব্যাপক ভাঙচুরের ফলে দুটি কারাগারে ব্যাপক ক্ষতি হয়। অনেক কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসস্থলও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে সেনাবাহিনীর তাৎক্ষণিক সহায়তায় কারা বিভাগ অদম্য সাহসিকতার সঙ্গে অন্যান্য কারাগারগুলো সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হয়।
কারা মহাপরিদর্শক আরও বলেন, পরবর্তীতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া অধিকাংশ বন্দীকেই কারাগারে ফেরত নিয়ে আসা সম্ভব হয়। এর মধ্যে কিছু বন্দী স্বেচ্ছায় এবং বাকিদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় গ্রেপ্তার করা হয়। এ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে কারাগারের লুটকৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদের উল্লেখ্যযোগ্য অংশও উদ্ধার করা হয়েছে। অবশিষ্টগুলো উদ্ধারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
কারা মহাপরিদর্শক বলেন, কারাগারকে সেবাগ্রহণকারীদের আস্থাভাজন হিসেবে গড়ে তোলাসহ একটি প্রকৃত সংশোধনাগার হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ইতিমধ্যে প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা প্রণয়নসহ দক্ষতা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পদায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
যেসব ধারা ব্যবহার করতে পারবে সেনাবাহিনী
যেসব ধারা উল্লেখ করে সেনাবাহিনীকে মেজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়া হয়েছে তাতে গ্রেফতারসহ অনেক কিছু করতে পারবে। ৬৪ ধারায় বর্ণিত ক্ষমতা অনুযায়ী তারা গ্রেফতার করতে পারবে। আর ১০৫ ধারা অনুসারে সরাসরি তল্লাশি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ৬৫ ধারায় গ্রেফতার করার ক্ষমতা, বা তার উপস্থিতিতে গ্রেফতারের নির্দেশনা জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন। ৮৩/৮৪/৮৬ ধারায় ওয়ারেন্ট অনুমোদন করার ক্ষমতা বা ওয়ারেন্টের অধীনে গ্রেফতারকৃত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অপসারণের আদেশ দেয়ার ক্ষমতা; ৯৫(২) ধারায় নথিপত্র ইত্যাদির জন্য ডাক ও টেলিগ্রাফ কর্তৃপক্ষের দ্বারা অনুসন্ধান এবং আটক করার ক্ষমতা; ১০০ ধারায় ভুলভাবে বন্দী ব্যক্তিদের হাজির করার জন্য জন্য অনুসন্ধান-ওয়ারেন্ট জারি করার ক্ষমতা; ১০৫ ধারায় সরাসরি তল্লাশি করার ক্ষমতা, তার উপস্থিতিতে যেকোনো স্থানে অনুসন্ধানের জন্য তিনি সার্চ-ওয়ারেন্ট জারি করতে পারেন। ১০৭ ধারায় শান্তি বজায় রাখার জন্য নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা; ১০৯ ধারায় ভবঘুরে এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ভালো আচরণের জন্য নিরাপত্তার প্রয়োজনীর ক্ষমতা; ১১০ ধারায় ভালো আচরণের জন্য নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা; ১২৬ ধারায় জামিনের নিষ্পত্তি করার ক্ষমতা; ১২৭ ধারায় বেআইনী সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার আদেশ দানের ক্ষমতা; ১২৮ ধারায় বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য বেসামরিক শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা; ১৩০ ধারায় বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা; ১৩৩ ধারায় স্থানীয় উপদ্রবে ক্ষেত্রে ব্যবস্থা হিসেবে আদেশ জারি করার ক্ষমতা; এবং ১৪২ ধারায় জনসাধারণের উপদ্রবের ক্ষেত্রে অবিলম্বে ব্যবস্থা হিসেবে আদেশ জারি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার মধ্যে গত ১৯ জুলাই দিবাগত রাতে সারা দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন ও কারফিউ জারি করেছিল তৎকালীন সরকার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। নতুন সরকারকে সহায়তা দিতে সারাদেশে কাজ করছে সেনাবাহিনী।
Share this content:
Post Comment