ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন বিচারকাঠামো

।। রাশেদ রাহম ।।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসচর্চা গত পাঁচ দশকে বদরুদ্দীন উমর থেকে বেশি দূর এগোয়নি। বদরুদ্দীন উমরের কালজয়ী গবেষণাগ্রন্থ পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি-এর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে, তৃতীয় ও সর্বশেষ খণ্ড ১৯৮৪ সালে। ১৯৯০ সালে বদরুদ্দীন উমরের কাঠামোকে অনুসরণ করেই সামাজিক গবেষণার আদলে ইউপিএল থেকে বের হয় ভাষা আন্দোলনের আর্থ-সামাজিক পটভূমি। আর্কাইভমূলক কিছু কাজের বাইরে এর পরের তিন দশকের ইতিহাসকারেরা তাঁদের শ্রম খরচ করেছেন প্রধানত স্বাধীনতার পরে রাজনীতিতে ক্রিয়াশীল বিবিধ পক্ষের (আওয়ামী [মুসলিম]) লীগ ও তার অঙ্গসংগঠন, তমুদ্দন মজলিসসহ ‘ডানপন্থী’ গ্রুপ এবং কমিউনিস্ট পার্টিসহ ‘বামপন্থী’দের ভূমিকা মূল্যায়নে। যার চূড়ান্ত পরিণতি দাঁড়িয়েছিল দেড় দশকজুড়ে ক্ষমতার চূড়ান্ত এককেন্দ্রীকরণের সমান্তরালে মুক্তিযুদ্ধের মতো ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকেও চরম একদেশদর্শী বয়ানে এঁটে ফেলার মধ্য দিয়ে।
ইতিহাসের সত্য যে কেবল তথ্যে নিহিত থাকে না, নানা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পটভূমির পাটাতনে এর যে নানা প্রকরণ তৈরি হয় এবং সমকালীন ইতিহাসচর্চা যে তথ্যের প্রথাগত সাংবাদ–প্রতিবেদনমূলক টালিকরণ থেকে বহুদূর এগিয়ে দর্শন-সমাজবিজ্ঞানের সীমানা ভেদ করেছে, সেই বোধ আমাদের মূলধারার ইতিহাসচর্চায় এখনো অস্ফুট রয়ে গেছে। ফলে উমরের পর ভাষা আন্দোলনের যে ইতিহাস রচিত হয়েছে, তা প্রধানত একরৈখিক এবং আমাদের চিন্তার ইতিহাসে তা নতুন কোনো মাত্রা যোগ করতে পারেনি। যেমন সাত দশক পরেও ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তানের বিচারব্যবস্থার কী ভূমিকা ছিল কিংবা কী রকম বিচারব্যবস্থার সহায়তায় পাকিস্তানের সামরিক-আমলাতান্ত্রিক অভিজাতরা জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে রুদ্ধ করে জবরদস্তিমূলক শাসনব্যবস্থা জারি করতে পেরেছিল, এসব নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। এমনকি উমরের পদ্ধতিগতভাবে প্রায়-স্বয়ম্ভু গ্রন্থেও তৎকালীন বিচারব্যবস্থাকে অ্যাড্রেস করা হয়নি।
২.
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের প্রধান ভূমিকা হলো আইনসভা কোনো গণবিরোধী আইন করলে কিংবা সেই আইনের ব্যবহার/অপব্যবহার করে নির্বাহী বিভাগ কোনো নিপীড়নমূলক সিদ্ধান্ত নিলে তার অযথার্থতা-অন্যায্যতা চিহ্নিত করে নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সমুন্নত করা। আদালত তার ভূমিকা পালন করতে সক্ষম কি না, তা মূল্যায়নের জন্য আদালতের গঠন এবং আইনি কাঠামো যার মধ্য থেকে আদালত বিচারকাজ সম্পন্ন করে, তা বিবেচনা করা দরকার। আবার আইন-আদালতের কাঠামো বৃহত্তর রাষ্ট্রকাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন করে বোঝা দুষ্কর।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্ম হয় ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রকাঠামোর প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকার নিয়ে। প্রথাগত ইতিহাসে ভারতে ব্রিটিশ বিচারব্যবস্থাকে ঔপনিবেশিক শাসনের ‘শাপেবর’ বা অকল্যাণের কল্যাণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু আদতে ‘ব্রিটিশ ন্যায়বিচার’ বা ‘আইনের শাসন’ ইত্যাদি ধারণাকে ঔপনিবেশিক শাসককুল ব্যবহার করেছেন তাদের দখলদারত্ব, কথিত ‘প্রাচ্যের স্বৈরতন্ত্রে’র বিপরীতে ‘সিভিলাইজিং মিশনে’র নামে তার অনন্ত শাসন-শোষণের বৈধতা নিরূপণের প্রধান মতাদর্শিক ও প্রায়োগিক অস্ত্র হিসেবে। আইন একদিকে স্থানীয় বিদ্রোহ আর প্রাত্যহিক শাসনের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাহায্য করেছে, শোষণ-নিষ্পেষণ ও সম্পদ-নিষ্কাশনের কাঠামো সরবরাহ করেছে, অন্যদিকে উপনিবেশিত প্রজাদের একটি ন্যায্য ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মাধ্যমে ব্রিটিশ ক্ষমতার প্রয়োগকে বৈধতা দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আইনি সাংবিধানিক কাঠামো ছিল বৈষম্যমূলক, বর্ণবাদী, নিপীড়নমূলক ও কর্তৃত্ববাদী, যার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো শাসন ও ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করা।
স্বভাবতই এটা ছিল গুটিকয়েক শাসন, ক্ষমতার ভরকেন্দ্র ছিল ওপরে ক্রাউনের প্রতিনিধিরূপে সার্বভৌম গভর্নর জেনারেল/গভর্নর (ও তার কাউন্সিল), নিচে একই সঙ্গে আইনি-নির্বাহী-বিচারিক ক্ষমতার অধিকারী স্বয়ম্ভূ প্রতিনিধি জেলা প্রশাসক। কখনো ‘উদারনীতিবাদ’ বা ‘উপযোগবাদ’, কখনো ‘পরোক্ষ শাসন’, ‘প্রতিনিধিত্বশীল সরকার’ কিংবা ‘স্ব-শাসন’ (সেলফ রুল/অটোনমি) ইত্যাকার নানা তত্ত্বকাঠামোতে সওয়ার হয়ে উনিশ শতকের ত্রিশের দশক থেকে শুরু করে পরবর্তী এক শতকজুড়ে নানা সংস্কার আনা হয় শাসনকাঠামোতে, কিন্তু কর্তৃত্ববাদী কাঠামো অটুট থাকে।
আমলাদের বানানো হয় নেটিভ মন্ত্রীদের প্রহরী, যাঁরা মন্ত্রীদের ডিঙিয়ে গভর্নরের কাছে রিপোর্ট করতেন। এমনকি ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রথম নির্বাচিত প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠিত হলেও আমলাতন্ত্রই ছিল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। বিচার বিভাগেরও নিয়ন্ত্রণ ছিল পরাক্রমশালী নির্বাহী বিভাগের কাছে।
ন্যায়বিচার ও সমতার কথা বলা হলেও বিচারিক কাঠামো নিজেই ছিল অবিচার ও অসমতার কারখানা। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্টের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি হওয়ার পর কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট এবং মফস্সলে নানা স্তরের দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা আবশ্যিকভাবে ব্রিটিশ এবং অধস্তনও আদালতে উচ্চ বিচারিক ক্ষমতাসম্পন্ন সব পদে বিচারিক কাজে অভিজ্ঞতাহীন ব্রিটিশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্য, কেবল নিম্ন দেওয়ানি পদগুলোতে স্থানীয়রা। ম্যাজিস্ট্রেসি বা ফৌজদারি বিচারের (প্রাথমিক তদন্ত, গ্রেপ্তার, জামিন কিংবা সুপ্রিম কোর্টে বিচারযোগ্য কোনো মামলা দায়েরের ক্ষমতা) ক্ষমতা কেবল ব্রিটিশদের হাতে, ১৮৪৩ নাগাদ স্থানীয়দের মধ্যে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের খবর পাওয়া যায়। কিন্তু আমূল বর্ণবাদী বিচারব্যবস্থায় ভারতীয় ম্যাজিস্ট্রেটদের ব্রিটিশদের এমনকি বহুকাল পর্যন্ত অব্রিটিশ ইউরোপীয়দেরও বিচার করার ক্ষমতা ছিল না, সাম্রাজ্যের অস্তকাল পর্যন্ত এ বিধান অক্ষুণ্ন থাকে। ভারতে বসবাসরত ইংরেজদের প্রবল বিরোধিতার কারণে ১৮৭৩ সালে ইলবার্ট বিলের যে পরিবর্তিত সংস্করণ পাস হয়, তাতে স্থানীয় বিচারকদের ইংরেজদের বিচারের ক্ষমতা দেওয়া হয় কেবল বিচারকাজে অর্ধেক ব্রিটিশ জুরি রাখার শর্তে। ফলে দারোগা বা ইংরেজ নীলকর জমিদারদের শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকারের জন্য স্থানীয় প্রজাদের যেতে হতো সুদূর কলকাতার সুপ্রিম কোর্টে, সেই সুপ্রিম কোর্টের দায়রা (ফৌজদারি) বেঞ্চ আবার বসত বছরে মাত্র চারবার। ১৮৬১ সালে সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে কলকাতা হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হলেও বিচারিক বৈষম্য অটুট থাকে।
১৮৫৮ সালে রানির ঘোষণায় প্রজার মধ্যে সমতার কথা পুনর্ব্যক্ত করা হলেও ১৮৭৭ সাল নাগাদ দেখা যায় ভারতে কমপক্ষে তিনটি আলাদা ফৌজদারি কোড বিদ্যমান: ‘মফস্সল আদালতের জন্য ফৌজদারি কার্যবিধি, দ্য হাইকোর্টস’ ক্রিমিনাল প্রসিডিউর অ্যাক্ট এবং প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট অ্যাক্ট।
উনিশ শতকের শেষ নাগাদ রাজনৈতিক দল, সভা-সমিতি আর সংবাদপত্রের উত্থানের ফলে মতপ্রকাশ-সংক্রান্ত অপরাধগুলো আবিষ্কৃত হতে থাকে। আদি দণ্ডবিধিতে না থাকলেও ১৮৭০ সালে ‘সেডিশন’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ যোগ করা হয়। ১৮৭৮ সালে সংবাদপত্র দমনের আইন হয় এবং ১৮৮৩ নাগাদ সংবাদপত্রে লেখার জন্য প্রথম গ্রেপ্তার (সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী)। প্রথমে স্বদেশি/সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন (১৯০৬-০৭) পরে খেলাফত-অসহযোগকে (১৯১৯-২০) কেন্দ্র করে মতপ্রকাশের ওপর দমন-পীড়নের আরও বিস্তৃততর হয়। বেয়াড়া নাগরিক প্রজাদের ঠেকানোর জন্য ‘অবৈধ সমাবেশ’ বা ১৪৪ ধারার মতো অস্ত্র আবিষ্কৃত হয় (১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি)। ক্রিমিনাল ল সংশোধন করে পুলিশি ক্ষমতা বাড়ানো হয়। খাজনা তোলার বিরুদ্ধে প্রজা-বিদ্রোহকে ডাকাতি’ নাম দিয়ে তা ঠেকানোর জন্য পুলিশের উদ্ভব হয়েছিল, তারা এবার তরুণ স্বদেশিদের প্রতিরোধে স্কুল-কলেজ-হোস্টেল বা নাগরিক সভা-সমিতিতে উত্থিত হন, হরেদরে গ্রেপ্তার-গুলির অধিকার পান। সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রধান প্রতিভূ হিসেবে আবির্ভূত হয়ে পুলিশ, বিচারিক দায়মুক্তিসহ। যুদ্ধকালে সংহতির নামে ‘জরুরি অবস্থা’ আবিষ্কৃত হয় যেখানে প্রজাদের সভা-সমাবেশ সবকিছুর অধিকার এককালীনভাবে কেড়ে নেওয়া যায়, নিবর্তনমূলকভাবে আটক করা যায় কিংবা সেনাবাহিনী নামিয়ে নির্বিচার গুলি। যুদ্ধকালে কিংবা জরুরি অবস্থায় বিচার বিভাগের ক্ষমতা স্থগিত/সীমিত থাকে, অন্য সময় বিচারকের সম্মতি পেতে সরকারকে কেবল বলতে হয় যে, সরকার বা গভর্নর এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে ধৃত ব্যক্তি ‘আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ’। বিচারক নিয়োগের ক্ষমতা ছিল নির্বাহী প্রধান/বিভাগের হাতে। ১৯৩৫ সালের সংস্কারে হাইকোর্টের বিষয়াবলি প্রাদেশিক সরকারের অধীনে আনা হলেও নির্বাহী-কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ন রাখা হয়। হাইকোর্টের ব্যয় বরাদ্দের ওপর প্রাদেশিক পরিষদে ভোট প্রদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
৩.
এই ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রকাঠামো নিয়েই পাকিস্তানের জন্ম হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রকাঠামোতে যে কর্তৃত্ববাদী একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্থিত হয়, তা-ই রাজনৈতিক বাঁকবদল পেরিয়েও অটুট থাকে। কেন্দ্রে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী গভর্নর জেনারেল এবং সামরিক-আমলাতান্ত্রিক কোটারি গোষ্ঠী; প্রদেশে গভর্নরের (প্রকারান্তরে মুখ্য সচিবের) একচ্ছত্র ক্ষমতা এবং একদলীয় প্রাদেশিক আইনসভা, যা ছিল সরকারি দল মুসলিম লীগের সংসদীয় কমিটির বর্ধিত অংশ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলা হলেও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার বদলে নিবর্তন-নিপীড়নমূলক আইনই নতুন রাষ্ট্রের ভাষা হয়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক আমলের বিস্তৃত নিপীড়নমূলক আইনি কাঠামোও তার জন্য যথার্থ প্রতিভাত হয় না। একের পর এক নিবর্তনমূক আইন প্রণীত হতে থাকে। দেশের সংবিধান প্রণয়নে ৯ বছর লাগলেও এক দশকে আমরা কমপক্ষে ১০টি নিপীড়নমূলক আইন প্রণীত হতে দেখি, যার অধিকাংশই প্রণীত হয় সংসদকে এড়িয়ে, নির্বাহী আদেশে। রাজনৈতিক ভিন্নমত ও নাগরিক অধিকার দলনের জন্য রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রায় সব রকম ধরনই ব্যবহৃত হতে থাকে। ঔপনিবেশিক আমলের দমনের যাবতীয় কলাকৌশল প্রস্তুত ছিল, পাকিস্তানি শাসকেরা কেবল তার নবরূপায়ণ করেছেন।
১৯৪৮ সালের ২৮ আগস্ট বরিশালের ব্রজমোহন কলেজের বিএসসি চতুর্থ বর্ষের ছাত্র নির্মল সেনকে (পরে বিখ্যাত সাংবাদিক) গ্রেপ্তার করা হয় সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করছে এমন গুপ্ত সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে। আরও ২০ জন রাজবন্দীর সঙ্গে এই আটকাদেশ হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়। বিচারপতি এলিস ও বিচারপতি ফজলে আকবরের বেঞ্চের সামনে শুনানিতে নির্মলের আইনজীবী আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, তার দল (রেভল্যুশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি অব পাকিস্তান—আরএসপি) আইনত নিষিদ্ধ নয় এবং দলের অধিকাংশ কর্মী জেলের বাইরে থেকে প্রকাশ্য কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
১৯৫০ সালের ২৮ আগস্টের রায়ে নাগরিক অধিকার নয়, আইনের অক্ষরের প্রতি অবিচল নিষ্ঠাবান বিচারপতি এলিস সিদ্ধান্ত জানান, বিচারক হিসেবে তাঁরা ‘আটককৃতের গ্রেপ্তার হওয়ার কোনো ভিত্তি ছিল কি ছিল না তা নিয়ে মোটেই চিন্তিত নয়।’ কেবল দেখতে হবে সরকারপ্রদত্ত আটকাদেশ বৈধ কি না এবং বৈধতার ভিত্তি হলো সরকারের ‘সদুদ্দেশ্য-প্রণোদিত’ সিদ্ধান্ত এবং ‘সাবজেক্টিভ স্যাটিসফ্যাকশন’ (নির্মল কুমার সেন বনাম ক্রাউন ৫৫ সিডব্লিউএন ২৫)। আমরা জানি এবং বিচারপতি নিজেও তাঁর মনোভাব গোপন করেননি যে এখানে তিনি রাষ্ট্রের ভাষায় কথা বলছেন, যে রাষ্ট্র ইতিমধ্যে ‘কমিউনিজম’কে নতুন ‘অপরাধ’ এবং ‘কমিউনিস্ট’দের ‘অপরাধী গোষ্ঠী’ হিসেবে আবিষ্কার করেছে।
ফলে দেখা যাচ্ছে, আইনের ফাঁকফোকরের কারণে বিনা বিচারে আটকাদেশের বৈধতা নির্ধারণ নির্ভর করত সংশ্লিষ্ট বিচারপতির নিজস্ব অবস্থানের ওপর। তাই সরকারের হাতে এই আইনের অপব্যবহারের ব্যাপক সুযোগ থেকে যায়।
৪.
১৯৪৭ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন ১৯৫২ সাল নাগাদ বৃহত্তর আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে গণবিস্ফোরণে পরিণত হয়েছিল। নির্বাহী বিভাগ নজিরবিহীন বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তা দমন করেছিল। কিন্তু বিচার বিভাগ কি সেই রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণ-সংক্রান্ত দুটি বিচারিক কার্যক্রম পর্যালোচনার মাধ্যমে আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করব।
ক. ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিলে গুলি: সংশ্লিষ্ট পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক দায়মুক্তি
২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের পূর্বনির্ধারিত হরতাল-সমাবেশের আগের দিন ১৪৪ ধারা জারি করে তা নিষিদ্ধ করা হয়। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল-সমাবেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পুলিশও ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে হাজির হয় তা প্রতিরোধে। সশস্ত্র-নিরস্ত্র-গ্যাস স্কোয়াড নিয়েডের কনস্টেবলদের প্রত্যক্ষ ফোর্স মোতায়েন করা হয় সকাল থেকে। ইন্সপেক্টর, সার্জেন্ট, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, এসপি, ডিএসপি, অ্যাডিশনাল এসপি, ডিআইজি এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হাজির ছিলেন। পুলিশি বাধার মুখে ছাত্রদের ইটপাটকেলের বিপরীতে পুলিশ লাঠিপেটা করে, কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। একপর্যায়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও ডিআইজির পরামর্শে এবং এসপির নির্দেশে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। সরকারি ভাষ্যমতে, কমপক্ষে ৩০ জন পুলিশ সদস্য ২৭টি গুলি করেন। কেবল রাস্তায় নয়, মেডিকেল হোস্টেলের ভেতরেও গুলি করা হয়। হোস্টেলের ভেতরেই গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যায় কেউ, একজনের মাথায় গুলি লেগে মগজ বেরিয়ে যায় বলে বিবরণ পাওয়া যায়। ‘প্রচুর রক্তে বারান্দার শেডের প্রশস্ত অংশ রঞ্জিত হইয়া ওঠে।…কয়েকটি বুলেট ১২ নম্বর শেডের দেওয়াল ভেদ করিয়া কামরার মধ্যে প্রবেশ করে…।’ ৩–৪ জন নিহত এবং ১৭ জন আহত হন। বহুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। (আজাদ, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)
২২ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার মিছিলে আবার গুলি করে পুলিশ। এবার পুলিশের সঙ্গে যুক্ত হয় ইপিআর ও সেনাবাহিনী। এতে চারজন নিহত ও শতাধিক আহত হন। জারি করা হয় কারফিউ। গুলিবর্ষণের আদেশদানকারী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনার চেষ্টা করেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। ২৫ মার্চ ১৯৫২। শহীদ আবুল বরকতকে গুলি করে হত্যা করার অপরাধে ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোরেশী, সিটি এসপি মাসুদ মাহমুদ, ডিআইজি এ জেড ওবায়দুল্লা এবং আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করে ঢাকা সদর মহকুমা হাকিম এন আহমদের এজলাসে একটা মামলা করার উদ্যোগ নেন বরকতের ছোট ভাই আবুল হাসনাত। আবেদনকারীর পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন আলী আমজাদ খান, আতাউর রহমান খান, এম রহিম, কামরুদ্দিন আহমদ, সৈয়দ শহিদুল হক ও শামসুল হক। সরকারপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন কোর্ট ইন্সপেক্টর কাজী জহুরুল হক। অভিযোগে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবুল বরকত ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে তাঁর বন্ধু মোরশেদ নেওয়াজের সঙ্গে দেখা করতে যান। মোরশেদ নেওয়াজ ১২ নম্বর শেডের একটি রুমে থাকতেন। সেখানে যাওয়ার পর বাইরে বিভিন্ন স্লোগান শুনে শেডের বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ান বরকত। কয়েকজন বন্দুকধারী পুলিশকে হোস্টেল এলাকায় প্রবেশ করতে দেখে রুমে ফিরে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে পড়ে যান। কয়েকজন তাঁকে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে যান। আহত অবস্থায় তিনি কর্তব্যরত কয়েকজন মেডিকেল ছাত্র ও অন্যদের কাছে আঘাতের বিবরণ দেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে সেই আঘাতের ফলে মারা যান। পুলিশ আবেদনকারীর অনুরোধ সত্ত্বেও মৃতের আত্মীয়স্বজনের আসার অপেক্ষা না করে এবং ময়নাতদন্তবিহীনভাবে ওই রাতেই লাশ দাফন করে। মহকুমা হাকিম কোনোর ধরনের তদন্তের আদেশ ছাড়াই মামলার আবেদন খারিজ করে দেন। তাঁর যুক্তি ছিল, অভিযুক্তরা সবাই–ই সরকারি কর্মকর্তা। ২০ ফেব্রুয়ারি যে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল, তা কার্যকরের জন্যই ‘তাঁরা ঘটনার সময় কর্তব্যে নিযুক্ত ছিলেন। সুতরাং অভিযোগের বিবরণ অনুযায়ী তাঁরা যা কিছু করেছেন, তা নিজ নিজ কর্তব্য হিসেবে করেছেন।’ আরও বলা হয়, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৩২ (পুলিশ) ও ১৯৭ (বিচারক/ম্যাজিস্ট্রেট) ধারা অনুযায়ী সরকারের অনুমোদন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা যাবে না। বর্তমান আবেদনকারী তাঁর অভিযোগের সঙ্গে এ রকম অনুমতিপত্র দাখিল করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে অভিযোগটি খারিজ করে দেওয়া হয় (আজাদ, ২৬ ও ২৯ মার্চ ১৯৫২ )। এভাবে গুলির প্রত্যক্ষ আদেশদানকারী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের যে আইনি দায়মুক্তি, তা বিচারিকভাবে স্বীকৃতি পায়। তা ছাড়া আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আসে সরকার গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে (২৭ মে ১৯৫২), যেখানে সরকারি ভাষ্যের অনুকরণে বলা হয়, গোলযোগকারীদের মুহুর্মুহু ইটপাটকেলের মুখে কাপড়ের টুপি পরা অরক্ষিত পুলিশ নিরুপায় হয়ে গুলি করেছে এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় বলপ্রয়োগ যথার্থ ছিল। ( এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখুন, রাশেদ রাহম [সম্পা.], এলিস কমিশন রিপোর্ট: ২১ ফ্রেব্রুয়ারি ১৯৫২ ছাত্র হত্যাকাণ্ড, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ২০১৮)।
অথচ ২৫ ও ২৮ মার্চ মামলা খারিজ হওয়ার সপ্তাহ দুইয়ের মধ্যে (৮-১৮ এপ্রিল) এলিস কমিশনের কাছে প্রদত্ত সাক্ষ্যে ঢাকার পুলিশ সুপার মো. ইদ্রিস পরিষ্কার স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন, ‘জনতা বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে এগিয়ে আসছিল। আমাকে সশস্ত্র বাহিনীর কাছে আসতে হয় এবং তাদের অবস্থানে পাঠাতে হয়। যখন পরিস্থিতি এমন হয়ে পড়ে যে আমরা চারপাশ থেকে ঘেরাওকৃত এবং নিরুপায় হয়ে পড়ছি, তখন আমি সেখানে উপস্থিত ডিএম [জেলা ম্যাজিস্ট্রেট] ও [পুলিশের] ডিআইজির সঙ্গে পরামর্শ করি। আমরা গুলি করার সিদ্ধান্ত নিই।’ (এলিস কমিশন রিপোর্ট, অনুচ্ছেদ ৩৪) জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এস এইচ কুরাইশীও তাঁর সাক্ষ্যে বলেন, ‘…আমার বিবেচনায় এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য গুলিবর্ষণ ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা খোলা ছিল না। তখন এসপি আমার কাছে গুলিবর্ষণের অনুমতি চান এবং আমি তাঁকে গুলিবর্ষণের অনুমতি প্রদান করি।’ পুলিশের উপমহাপরিদর্শক এ জেড ওবায়দুল্লাহ জানান, ‘…এ সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও আমার পরামর্শে চূড়ান্ত সতর্কবার্তা দেওয়ার পর এসপি গুলিবর্ষণের আদেশ দেন।…এসপির সরাসরি তত্ত্বাবধানে গুলি করা হয়।’
কিন্তু এই যথার্থতা নিরূপণের মানদণ্ড কী? সেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ‘বিবেচনা’, অভিজ্ঞ বাঙালি কর্মকর্তাকে সরিয়ে যাঁকে ২১ ফেব্রুয়ারির আগের দিন বদলি করে এনেছিলেন পূর্ববঙ্গে কেন্দ্রের রুলিং কোটারির প্রধান প্রতিনিধি মুখ্য সচিব আজিজ আহমেদ? সরকার তথা গভর্নর তথা মুখ্য সচিব সোজা কথায় ক্ষমতাসীন অভিজাতরা যথাযথ ‘বিবেচনা’ করলেই বিক্ষোভরত নাগরিকদের ওপর গুলি করা যাবে? পুলিশ–ম্যাজিস্ট্রেট কেউ দায়ী নয়, সভা-সমাবেশের নাগরিক অধিকার সমুন্নত চর্চা করতে আসা নিরস্ত্র ছাত্ররা সশস্ত্র পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারাল, এর দায় তাহলে কার?
রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখার জন্য পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটকে কর্তব্যে নিয়োজিত করে দায়মুক্তি দিয়েছে রাষ্ট্র ও তার আইন। তাহলে এই দায় রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রের ঘাড়ের ওপর সওয়ার গদিনাসীন সরকারের। কিন্তু রাষ্ট্র কিংবা নির্বাহী সরকারকে বিচারিক জবাবদিহিতে আনার আদৌ কি কোনো উপায় আছে এই আইনি-বিচারিক কাঠামোতে, যেখানে রাষ্ট্র ব্যক্তি-সমাজ, প্রাণ-প্রকৃতিসহ তাবৎ অস্তিত্বকে আইনের অধীন করে, কিন্তু নিজেকে স্থাপন করে আইনের ঊর্ধ্বে?
খ. খয়রাত হোসেন ও মাওলানা তর্কবাগীশের মামলা: পরিষদে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদের কারণে নিরাপত্তা আইনে বন্দী
২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে পুলিশের গুলিবর্ষণের সময় পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন চলছিল। গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ পরিষদে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন। ‘যখন আমার চক্ষের মানিক, আমাদের রাষ্ট্রের ভাবী নেতা, ছয়জন ছাত্র রক্তশয্যায় শায়িত, তখন আমরা পাখার নিচে বসে হাওয়া খাব, এ আমি বরদাশত করতে পারব না। আমি জালিমের এ জুলুমের প্রতিবাদে পরিষদগৃহ পরিত্যাগ করছি এবং মানবতার দোহাই দিয়ে…সকল মেম্বারের কাছে পরিষদগৃহ ত্যাগের আবেদন জানাচ্ছি।’ এ কথা বলে তিনি পরিষদ ত্যাগ করেন।
২২ ফেব্রুয়ারি অধিবেশন তর্কবাগীশ ও অপর সদস্য খয়রাত হোসেন পুলিশের গুলিতে আহত-নিহতদের নিয়ে আলোচনার জন্য অধিবেশন মুলতবি এবং একটি শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। শোকপ্রস্তাব প্রাদেশিক সরকারের এখতিয়ারভুক্ত—স্পিকারের এমন বক্তব্যের উত্তরে খয়রাত হোসেন বলেন, ‘আমরা ইংল্যান্ডের রাজা মরলে শোকপ্রস্তাব পাস করতে পারি আর দেশের ছেলেরা গুলির আঘাতে মরলে তাদের বিষয়ে পারি না?’ শেষ পর্যন্ত মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করতে দেওয়া হয়। কিন্তু ১৭১ সদস্যের পরিষদে মাত্র ৩৫ জন সমর্থন করায় তা নাকচ হয়ে যায় (বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, ৩য় খণ্ড, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশ, ১৯৯৫)। তবে সরকারি দলের পরিষদ–সদস্য হয়েও তাতে সরকারের রোষানল থেকে মুক্তি মেলে না খয়রাত হোসেন ও তর্কবাগীশের। কারণ, এর মধ্যে তিনি মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি কমিটি থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ২৩ তারিখ কমিটিতে উপস্থিত হওয়া থেকে বিরত থাকেন।
ডামাঢোলের মধ্যে ২৪ ফেব্রুয়ারি স্পিকার পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন এবং ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে খয়রাত হোসেন ও তর্কবাগীশকে তাঁদের ২ নম্বর সিম্পসন রোডের সরকারি বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে পূর্ব পাকিস্তান জননিরাপত্তা অধ্যাদেশ ১৯৫১-এর অধীনে আটক দেখানো হয়। প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, পরে ২৮ ফেব্রুয়ারি সেখান থেকে বগুড়া কারাগারে পাঠানো হয়। আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ করে তাঁরা একটি রিট আবেদন করেন। মামলায় আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে ছিলেন আবদুস সালাম খান (১৮৭৩-১৯৬২) এবং সরকারপক্ষে তৎকালীন অ্যাডভোকেট জেনারেল (১৯৫১-৫৩) শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও কে হোসেন। পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে আবদুস সালাম খান বলেন, ওয়েস্ট মিনিস্টার সংসদীয় রীতি অনুযায়ী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে তাঁর দুই মক্কেল বিশেষ সুবিধার অধিকারী এবং গ্রেপ্তার থেকে সুরক্ষিত। এ ছাড়া ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদের কারণে অসদুদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এই জনপ্রতিনিধিকে গ্রেপ্তার করেছে সরকার। সরকারপক্ষের আইনজীবী ফজলুল হক হাউস অব কমন্স সদস্য ক্যাপটেন রামসে (১৯৪০) এবং মাদ্রাজ প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য পিল্লামারি ভেঙ্কটসরলুর (১৯৪০) মামলার নজির টেনে দেখান যে আগের ২০০ বছরে সংসদ সদস্যদের গ্রেপ্তার থেকে সুরক্ষার সুবিধা দেওয়ানি মামলা ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে গৃহীত হয়নি। বর্তমান মামলা যেহেতু নিরাপত্তা আইনের অধীনে, তাই এ ক্ষেত্রে এই যুক্তি প্রযোজ্য নয়। আবেদনকারীপক্ষের দ্বিতীয় যুক্তির বিপক্ষে তাঁর বক্তব্য ছিল, সরকারের হাতে থাকা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য ও সদুদ্দেশ্যেই সরকার আবেদনকারীদের গ্রেপ্তার করেছে এবং গ্রেপ্তারের কারণ বিস্তারিতভাবে তাঁদের জানানো হয়েছে। এর চেয়ে বেশি তথ্য প্রকাশ করাকে সরকার ‘জনস্বার্থের জন্য হানিকর’ বলে বিবেচনা করছে।
অথচ মাওলানা তর্কবাগীশ তাঁর সাক্ষাৎকারে আমাদের জানাচ্ছেন ভিন্ন ঘটনা। ২৪ তারিখ নূরুল আমীনের রাজনৈতিক সচিব ইসকান্দার খান পার্টি হাউসে এসে তর্কবাগীশকে পরামর্শ দেন যে তিনি যাতে পরিষদে সরকারের বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাব তুলে নেন। না হলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। ‘…সে আমাকে আরও বলল যে…না করলে অসুবিধা হবে।’ তর্কবাগীশ তাতে গা করেননি। রাত নয়টার সময় ইসকান্দার আবার এলেন। বললেন, ‘…অনাস্থা প্রস্তাব তুমি প্রত্যাহার করো। আমার একটা বাড়ি এবং যথেষ্ট টাকাকড়ির ব্যবস্থা করা হবে,’ এ কথাও তিনি বললেন। আমি তাঁকে সেবারও আমার অসম্মতি জানালাম। তর্কবাগীশ আমাদের জানাচ্ছেন, ইসকান্দার শেষবার এলেন রাত এগারোটার দিকে এবং বললেন, ‘দেখো বাপু, আমি তোমাকে বন্ধু হিসেবে বলছি। সাধু হয়ে লাভ নেই। প্রস্তাব মেনে নাও। সেটা রাজি না হলে চারদিকে বাইরে তাকিয়ে দেখো, পুলিশ পার্টি হাউস ঘিরে রেখেছে। তোমাকে গ্রেপ্তার করতে পারে।’ তর্কবাগীশ তবু নাছোড়বান্দা। ‘এরপর সে আমাকে নানাভাবে বন্ধুসুলভ ভালোবাসার গালাগালি দিয়ে বিদায় নিল।’ রাত তিনটার দিকে রুমের দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ শুনে দরজা খোলার পর তর্কবাগীশ দেখলেন, দারোগাসহ কয়েকজন পুলিশ হুড়মুড় করে তাঁর কামরায় ঢুকে পড়েছে। কিছুক্ষণ পর খয়রাত হোসেন তর্কবাগীশের রুমে এলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওয়ারেন্ট কি শুধু তর্কবাগীশের বিরুদ্ধেই আছে না অন্য কারও বিরুদ্ধেও?’ পুলিশ বলল, ‘আপনাকেও আমরা গ্রেপ্তার করব।’ কোনো পরোয়ানা ছাড়া তারা খয়রতাকেও গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল। (আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের সাক্ষাৎকার, ৩০ এপ্রিল ১৯৬৯; বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ: কতিপয় দলিল, দ্বিতীয় খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৫)=
সরকারি নিপীড়নের পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে শেরে বাংলাকে ছদ্ম-দার্শনিকতার আশ্রয় নিতেও দেখা যায়। তিনি বলেন, ‘কখনো কখনো সমাজের অধিকার ব্যক্তির অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক হয় এবং সমাজের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ব্যক্তিকে বিনা বিচারে আটক করার প্রয়োজন পড়ে, তখন ব্যক্তিকে অবশ্যই আটকে রাখতে হয়।’ অ্যাডভোকেট জেনারেল ব্যবহৃত ‘সমাজ’ শব্দটি এখানে আলংকারিক, এর তাৎপর্যগত অর্থ হলো ‘রাষ্ট্র’ এবং তিনি রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে সওয়াল-জবাব করছিলেন। বিচারকও রাষ্ট্রই নিয়োগ করে (নাকি সরকার?) যিনি ঔপনিবেশিক আইনের যে ভাষা (অত্যাবশ্যকীয়ভাবে রাষ্ট্রবাদী এবং নাগরিকবিরোধী) তাতে পূর্ণ ইমান রেখে আমল করার জন্য নিয়োজিত হয়েছেন। আইনের নীতি অনুযায়ী অধস্তন আদালত সরকারি সিদ্ধান্তের যথার্থতা নিরূপণের ক্ষমতা রাখে না, কিন্তু হাইকোর্টের সে ক্ষমতা থাকে জুডিশিয়াল রিভিউর অধীনে। কিন্তু সে ক্ষমতার প্রয়োগ-অপ্রয়োগ নির্ভর করে আদালত-বিচারকের ওপর নির্বাহী প্রভাবের মাত্রার ওপর। ফলে অ্যাডভোকেট জেনারেলের বক্তব্য তাঁর যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। আটকাদেশ বৈধ, পিটিশন খারিজ। তর্কবাগীশ জেল থেকে ছাড়া পান ১৩-১৪ মাস পরে, ১৯৫৩ সালের ৩০ মে।
এভাবে আইনের যুক্তিসর্বস্বতা ব্যক্তির অধিকারের বিপরীতে দাঁড়ায়। নিপীড়নমূলক আইনি-বিচারিক কাঠামোতে ব্যক্তি কর্তাসত্তাহীন জড়বস্তুতে পরিণত হন, যাঁকে রাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী কাঠামোতে সহজে আঁটানো যায়। পাকিস্তান পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশেও এ কাঠামো অক্ষুণ্ন থাকে, অনন্ত কর্তৃত্ববাদের কবলে ধুঁকতে থাকে জনগণ।
রাশেদ রাহম: আইনের ইতিহাস গবেষক।
Share this content:
Post Comment