বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় সামাজিক ও গণমাধ্যমে সাম্প্রদায়িক উসকানি

লণ্ডন, ১৬ আগস্ট- বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়ায় অপতথ্য ও ভুয়া ভিডিও ছড়ানো হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই ভুয়া ভিডিও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও প্রচারিত হচ্ছে। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় সামাজিক ও গণমাধ্যমে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়া হচ্ছে।  ভারতের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিততে সাম্প্রদায়িকতার আগুন উসকে দিয়েছে। বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ইস্যুতে বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যম অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাও হতাশাজনক।

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা নিয়ে ভারতের মূলধারার কিছু গণমাধ্যম ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কেউ কেউ অপতথ্য ছড়াচ্ছেন বলে বেরিয়ে এসেছে রিউমর স্ক্যানারের একটি প্রতিবেদনে। তথ্য যাচাইকারী বা ফ্যাক্ট চেকার প্রতিষ্ঠানটি একে ‘সাম্প্রদায়িক অপতথ্য প্রচারের ভয়াল রূপ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। রিউমর স্ক্যানার এক্স-এর ৫০টি অ্যাকাউন্ট খুঁজে বের করেছে, যেখানে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।  তার ভিত্তিতে দেখা গেছে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সম্পর্কে জাল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হয়েছে যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশই ভারতভিত্তিক।

৯ আগস্ট ‘বাবা বানারাস (Baba Banaras) ’ নামে একটি ভারতীয় একটি ভেরিফায়েড এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ১ মিনিট ২৬ মিনিটের একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়, ঢাকায় একটি হিন্দু হোস্টেলে নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামী হামলা চালিয়েছে। হামলা থেকে বাঁচতে হোস্টেলের কার্ণিশে এসে ঝুলতে থাকেন। এ সময় অনেক শিক্ষার্থী নিচে পড়ে যান আবার কেউ ভয়েও পড়ে যান। তাঁরা বেঁচে আছেন না মারা গেছেন তা জানা যায়নি। অথচ ভিডিওটি নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভাইরাল ভিডিওটির সঙ্গে সাম্প্রদায়িক হামলার কোনো সম্পর্ক নেই। ভাইরাল ভিডিওটি চট্টগ্রামের মুরাদপুরের। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে গত ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের মুরাদপুরে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা।

একই ভেরিফায়েড এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ৬ আগস্ট ভাস্কর্যের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা এক ব্যক্তির মরদেহের ২০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়, ঝুলিয়ে রাখা মৃত ব্যক্তিটি একজন বয়স্ক হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাঁকে মেরে ঝুলিয়ে রেখেছে জামায়াতে ইসলামী। অথচ, ভিডিওটি সম্পর্কে রিভার্স ইমেজ অনুসন্ধানে ‘করপোরেট সংবাদ’ নামের একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে ভাইরাল ভিডিওটি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ঝুলিয়ে রাখা ব্যক্তির নাম শহিদুল ইসলাম হিরণ (৭৫)। তিনি ঝিনাইদহ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় পোড়াহাটী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান।

‘সুদর্শন বাংলা (Sudarshan Bangla) ’ নামের ভারতের একটি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের ভেরিফায়েড এক্স অ্যাকাউন্টে ১৯ সেকেন্ডের একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, হিন্দু নারীদের বেঁধে রেখেছে মুসলিম নারীরা। ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে, একদল তরুণী দুজন তরুণীকে পিলারের সঙ্গে বাঁধছেন। আজকের পত্রিকার ফ্যাক্ট চেক বিভাগের অনুসন্ধানে দেখা যায়, হিন্দু নারীদের মুসলিম নারীরা বেঁধে রেখেছেন দাবিতে ভাইরাল ভিডিওটি গত ১৭ জুলাইয়ের। ওই সময় বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রলীগ নেত্রীদের বেঁধে রাখেন কলেজটির শিক্ষার্থীরা।

কেবল ভারতীয় এক্স হ্যান্ডেল নয়, রীতিমতো সংবাদমাধ্যম নামধারী কিছু ওয়েবসাইট ও তাদের পেজ থেকে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ ও সারজিস আলমের ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পোস্ট ব্যবহার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও এক্সে (সাবেক টুইটার) সমন্বয়ক সারজিস আলমের একটি পোস্ট ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দাবি করা হয়ে, ‘আগামীর রাষ্ট্র হবে ইসলাম, সংবিধান হবে আল কোরআন–ইনশা আল্লাহ।’ কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই না করেই ‘অপইন্ডিয়া’ নামে একটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও সারজিস আলমের কথিত পোস্টের ছবি শেয়ার করে একটি টুইট করে। তবে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্ট চেক বিভাগের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফেসবুক ও এক্সে ছড়িয়ে পড়া এই পোস্ট সারজিস আলমের নয়। সেটি ছিল ভুয়া অ্যাকাউন্ট।

 ৯ আগস্ট এক হিন্দু ব্যক্তি তাঁর নিখোঁজ ছেলের হদিস চেয়ে একটি ভিডিও শেয়ার করেন। দাবি করা হয়, এটি বাংলাদেশের। ভারতের অন্তত তিনটি মূলধারার গণমাধ্যম—এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল (এএনআই), এনডিটিভি এবং মিরর নাউ—তাদের এক্স হ্যান্ডেলে সেই ভিডিওটি বাংলাদেশের ঘটনা বলে শেয়ার করে। তবে সেই ব্যক্তিটি কোনো হিন্দু ছিলেন না। তাঁর নাম বাবুল হাওলাদার। তাঁর ধর্ম ইসলাম। তিনি ওই ভিডিওতে ২০১৩ সাল থেকে নিখোঁজ ছেলের বিষয়ে তথ্য চেয়েছিলেন এবং এই কারণে একটি প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন। পরে অবশ্য এএনআই সেই টুইটটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।

ভারতীয় এক্স অ্যাকাউন্টগুলো থেকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের গুজব থামছেই নাভারতীয় এক্স অ্যাকাউন্টগুলো থেকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের গুজব থামছেই না মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো খুব একটা অংশ না নিলেও মূলত ভারতীয় এক্স অ্যাকাউন্টগুলো থেকেই সবচেয়ে বেশি গুজব ছড়ানো হয়েছে। এর আরেকটি প্রমাণ হলো—বিক্রম প্রতাপ সিং নামের একটি ভেরিফায়েড এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে গত ১২ আগস্ট বাংলাদেশি অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনের বক্তব্যের ১৩ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপ পোস্ট করে দাবি করা হয়, ‘এটি একজন হিন্দু নারীর আর্তনাদ। হিন্দুরা বাংলাদেশে আতঙ্কে আছে। তাঁদের সামনে দুটি পথ খোলা। হয় বাংলাদেশ ছাড়ো নয়তো ধর্মান্তরিত হও।’

ভিডিওটি নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ১ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফা দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন দৃশ্যমাধ্যম শিল্পী সমাজ। এ সমাবেশে অংশ নেন অভিনেতা মোশাররফ করিম, সিয়াম আহমেদ, জাকিয়া বারী মম, রোবেনা রেজা জুঁই, নির্মাতা অমিতাভ রেজাসহ অনেক শোবিজ তারকা। এতে অংশ নেন অভিনেত্রী আজমেরি হক বাঁধনও। সেখানে বক্তব্য দেওয়ার ফুটেজ ব্যবহার করে বাঁধনকে হিন্দু নারী হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে এক্সে।

দীপক শর্মা নামের একটি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ৯ আগস্ট একটি ভিডিও পোস্ট করে দাবি করা হয়, বাংলাদেশের হিন্দু নারী ও শিশুদের একটি শিবিরে (ক্যাম্প) জিহাদিরা বোমা হামলা চালিয়ে শত শত নারীকে হত্যা করেছে। যদিও রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, এটি গত ৭ জুলাই বগুড়ায় জগন্নাথ দেবের রথযাত্রায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনার ভিডিও। এক হিন্দু ব্যক্তি তাঁর নিখোঁজ পুত্রের সন্ধান দাবিতে মানববন্ধন করছেন—এমন দাবি করে একটি ভিডিও ভারতের মূলধারার গণমাধ্যম এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল (এএনআই), এনডিটিভি, মিরর নাউ–এর এক্স অ্যাকাউন্টে প্রচার করা হয়। তবে রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, ওই ব্যক্তি মুসলমান। তাঁর নাম বাবুল হাওলাদার। তিনি ২০১৩ সাল থেকে নিখোঁজ থাকা তাঁর ছেলের সন্ধানের দাবিতে এই মানববন্ধনে অংশ নিয়েছিলেন।

ভারতের আরেক পরিচিত গণমাধ্যম অপিইন্ডিয়ার প্রধান সম্পাদক নূপুর শর্মাও তাঁর এক্স অ্যাকাউন্টে নিয়মিত বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ছড়িয়েছেন বলে উল্লেখ করেছে রিউমর স্ক্যানার। তারা বলছে, ১১ আগস্ট প্রকাশিত নূপুর শর্মার একটি এক্স পোস্টকে ভুয়া তথ্য হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁকে জানানো হয়। এরপর তিনি রিউমর স্ক্যানারের একজন সদস্যকে এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ‘ব্লক’ করেন। অপইন্ডিয়ার প্রধান সম্পাদক নূপুর শর্মা, যিনি ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির কর্মী ছিলেন। ভারতীয় ফ্যাক্টচেকিং প্ল্যাটফর্মগুলো নূপুরের বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই জাল খবর ছড়ানোর অভিযোগ তুলেছে।

ভারতের ফ্যাক্টচেকার অঙ্কিতা দেশকারের কাছে রিউমর স্ক্যানার জানতে চেয়েছিল, কেন সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে সাম্প্রদায়িক প্রচারের হার বেড়েছে। অঙ্কিতা বলেছেন, সাম্প্রদায়িক ভুল তথ্য পোস্ট করার মাধ্যমে অ্যাকাউন্টগুলো তাদের ফলোয়ারদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য সাড়া পেয়ে থাকে। অনেকেই তাই নিজেদের এনগেজমেন্ট বা রিটুইট সংখ্যা বাড়াতে এসব অপতথ্য এক্সে শেয়ার করছেন।

এ ছাড়া ভিন্ন ঘটনার পুরোনো ভিডিও, মুসলিমদের স্থাপনায় সাম্প্রতিক হামলাকে হিন্দুদের স্থাপনায় হামলা দাবি, ভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে হিন্দুদের স্থাপনায় হামলার দাবি, রাজনৈতিক স্লোগানের বক্তব্যকে ভিন্ন দাবি, স্ক্রিনশট বিকৃতি, ভুয়া বক্তব্য, বিএনপির নামে ভুয়া টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্টের বরাতে ভুল তথ্য এবং হিন্দু নিহতের সংখ্যা নিয়ে ভুয়া দাবির মাধ্যমে ভুয়া তথ্যের প্রচার লক্ষ করেছে রিউমর স্ক্যানার। পোস্টগুলোতে ভুয়া তথ্যের প্রচারে ৮০ শতাংশ (৪০টি) ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়েছে ভিডিও। ১৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ছবি ও স্ক্রিনশট এবং বাকি ৪ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে ছবি/ভিডিওবিহীন পোস্ট।

বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত নিহত হন অন্তত ৩৫৪ জন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে গত শুক্রবার পর্যন্ত ২৭০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৬২৪ জনের। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা এবং তাঁদের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। হামলা হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরও।  তবে তা বাড়িয়ে প্রচার করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে অপতথ্য। গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়ই ভিডিওর আশ্রয় নিয়েছে অ্যাকাউন্টগুলো।

Share this content:

Post Comment

অন্যান্য