নিষিদ্ধ এনজিও চালাতেন মনিরুল, সন্ত্রাসীদের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন নুরুল
- লণ্ডনে আনোয়ারুজ্জামানের ব্যবসায় মনিরুলের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ।
লণ্ডন, ১৭ সেপ্টেম্বর- এক সময়ের প্রবল প্রতাপশালী পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ এসবি’র সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, এই অতিরিক্ত আইজিপি’র অনিয়মের শেষ নেই। ডিএমপি’র যুগ্ম কমিশনার থেকে এসবি প্রধান। গত ১০ বছরে নাটকীয় উত্থান। অল্প সময়ে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। ক্রসফায়ারের হুমকি, তুলে নিয়ে ডিবি দিয়ে নির্যাতন, বিঘায় বিঘায় জমি দখল, বাড়ি দখল, ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে কোটি টাকা আদায়, মামলা বাণিজ্য, জঙ্গি নাটক সাজিয়ে মালিককে গ্রেপ্তার করে এনজিও ছিনতাই, শ্যালককে দিয়ে পিডব্লিউডির টেন্ডারবাজি এমন কোনো কাজ নেই, যা করেনি এই মনিরুল।
তবে এবারে দৈনিক মানবজমিনের এক প্রতিবেদনে জঙ্গি দমনে কাজ করা এই মনিরুল নিজেই জঙ্গিবাদে অর্থদাতা হিসেবে পৃথিবী জুড়ে নিষিদ্ধ দুটি এনজিও পরিচালনায় জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে। মনিরুল ইসলাম বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক দুটি এনজিওর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সূত্র বলছে, ১৯৯৪ সালে কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি নামে একটি এনজিও বাংলাদেশে তাদের প্রথম কার্যক্রম শুরু করেন। এটি পরিচালনা করতেন একটি প্রভাবশালী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয়সারির নেতা মো. জামাল আব্দুল খালেক আল নুরী। প্রথমদিকে এনজিওটি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা নির্মাণ ও ছিন্নমূল বয়স্ক মানুষের পুনর্বাসনের কাজ করতো। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬ সালে মনিরুল ইসলাম জঙ্গি দমনে গঠিত কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান হয়েই কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি নামে এনজিওটির চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করেন। পরে এনজিওটি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। নাম সংস্কার করে কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ নাম দেন। এরপর দখল করেন শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল নামের আরেকটি এনজিও। জাতীয় এনজিও ব্যুরোর নথি বলছে, ২০১৭ সালে নভেম্বর মাসের ২ তারিখে কুয়েত জয়েন্ট কমিটি এনজিওটির নাম পরিবর্তন করা হয়। যাতে মনিরুল ইসলাম সুপারিশ করেন। এরপর থেকেই এনজিও দুটি ভিন্ন নামে ভিন্ন রূপে নির্বিঘ্নে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যার নেপথ্যে ছিলেন এসবি সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম। তার প্রভাবে এই এনজিও কার্যক্রম নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলার সাহস পাননি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, জঙ্গিবাদে অর্থদাতা হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক এনজিও দুটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। বাংলাদেশেও এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি ২০১৭ সালে জঙ্গি সংগঠনগুলোর অর্থ জোগানদাতা হিসেবে চিহ্নিত ১৭টি এনজিওর তালিকা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই তালিকায় মনিরুল ইসলামের দখল করা এনজিও দুটির নামও ছিল। পরে নাম কিছুটা সংস্কার করে প্রভাব খাটিয়ে ওই তালিকা দেখে এনজিও দুটি দেন মনিরুল ইসলাম। গোপনে তিনি ওই এনজিওর মাধ্যমে কুয়েত থেকে অর্থ সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যান। তবে ২০১৭ সালে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি টের পেয়ে গেলে তিনি কৌশলে ওই এনজিওর মালিকানা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। পরে ২০১৮ সালে ২০শে জুন এনজিওটির চেয়ারম্যান বানানো হয় মনিরুল ইসলামের শ্যালক রেজাউল আলম শাহীনকে। অনুসন্ধান বলছে, দুটি এনজিও গত ৭ বছরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের নামে মধ্যপ্রাচ্য থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা অনুদান সংগ্রহ করে। যার নেপথ্যে ছিলেন মনিরুল ইসলাম নিজেই। বর্তমানে এনজিওটির নামমাত্র প্রধান গাজী জহিরুল ইসলাম। কিন্তু নাম থাকলেও এটি পরিচালনা করেন রেজাউল আলম শাহীন নিজেই। রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা ও পুনর্বাসনের নামে ৭ বছরে এই এনজিও মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা অনুদান এনেছে। নানা অনিয়ম, দুর্নীতিতে জড়ানো এই পুলিশ কর্মকর্তা শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরে গা ঢাকা দিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মনিরুলের লন্ডনের বিভিন্ন এলাকায় বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। মনিরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সিলেটের সদ্য সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ারের ব্যবসায় মনিরুলের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে বলে জানা গেছে। মনিরুলের একমাত্র ছেলে অনন্য ইসলামও লন্ডনে থাকেন। ছেলেই ওই ব্যবসা ও সম্পদের দেখভাল করেন। এ ছাড়া কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনের মিরপুর শাখায় মনিরুল ইসলাম, সায়লা ফারজানা ও শ্যালক শাহীনের গোপন বেশ কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। যে অ্যাকাউন্টগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে বলে ওই ব্যাংকের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন।
সন্ত্রাসীদের ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিলেন ডিআইজি নুরুল
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাজুড়ে আতঙ্কের নাম ছিল কথিত ‘এসপি লীগ’। এই এসপি লীগের আনাগোনা ছিল আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের। আর দূর থেকে এই এসপি লীগের সবধরনের কার্যক্রম চোখে চোখে রাখতেন ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম। ছিল নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনীও।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পান থেকে চুন খসলেই যাকে-তাকে হুমকি থেকে শুরু করে মারধর করতেন এসপি লীগের সদস্যরা। তাদের আয়ের মূল উৎস ছিল চাঁদাবাজি ও জমি দখল। পাশাপাশি মাদকের কারাবারতো ছিলই। স্থানীয়দের অভিযোগ, এই গ্রুপের সদস্যরা যেসব এলাকায় নিয়মিত মাদকদ্রব্য সেবন করতো, ওই এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন ঢুকত না। কারণ এসব বিষয়ে নজর না দিতে কড়া বার্তা ছিল ডিআইজি নুরুলের। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, নুরুল ইসলাম পরিবার ছিল খুবই গরিব। আওয়ামী লীগ সরকারের সু-নজরে পড়ার পর তার পরিবারের সদস্যরা নামের সঙ্গে ‘সৈয়দ’ লাগানো শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় নুরুলসহ তার আপন দুভাই নামের আগে সৈয়দ লাগান। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ তৈরি ও ব্যবহার করার অভিযোগও রয়েছে নুরুলের বিরুদ্ধে।
২০১৫ সালে নুরুল ইসলাম ঢাকা দক্ষিণ ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার ছিলেন। এ সময় তিনি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে ৬৮ বিঘা দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করেন। তারপর থেকেই আলোচনায় আসেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। এরপর থেকে তার চোখ পড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্থানীয় রাজনীতিতে। পুলিশে চাকরির সুবাদে সরাসরি তিনি রাজনীতির মাঠে না থাকলেও তার পরিবারের সদস্যদের সুযোগ করে দেন। এসবের প্রতিবাদ করতে গেলে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের দমন-পীড়নেও ছিল নুরুলের ব্যাপক ভূমিকা। এসব নিয়ে সাংবাদিকদের লেখাও ছিল বারণ। কারণ গণমাধ্যমকর্মীদের চাপে রাখতো নুরুলের সন্ত্রাসী বাহিনী।
২০১৫ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নুরুল ইসলামের নির্দেশে তার সন্ত্রাসী বাহিনী ৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এমন অভিযোগও আছে, এসব মামলায় তার মতের বিরোধিতাকারীদের ‘ফাঁসানো’ হয়।
নুরুর ইসলামের আপন দু’ভাই নজরুল ইসলাম ও মুনিরুল ইসলাম। নজরুল শিবগঞ্জ উপজেলার একটি কলেজের প্রভাষক ছিলেন। একই সঙ্গে ইটভাটা ব্যবসায়ী। আরেক ভাই মুনিরুল পেশায় ছিলেন ঠিকাদার। ক্ষমতার জোরে নুরুল তার ভাই নজরুলকে উপজেলা পরিষদের চেয়্যারমান বানান। নজরুল নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। অথচ তিনি (নজরুল) ছিলেন শিবগঞ্জ পৌরসভা ৭নং ওয়ার্ডের বিএনপির সদস্য। নৌকা প্রতীকের পাশাপাশি নিজের ক্ষমতার ব্যবহার করে নজরুলকে চেয়ারম্যান বানান নুরুল। পরবর্তীতে তার ভাইকে বানিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। এদিকে তার আরেক ভাই মুনিরুলকে বানিয়েছেন শিবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সৈয়দ নুরুল ইসলামকে রাজশাহী সারদা পুলিশ একাডেমিতে সংযুক্ত করা হয়। তবে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, তিনি সারদা পুলিশ একাডেমিতে যোগ দেননি।
Share this content:
Post Comment