নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও দম্ভ শেষে শেখ হাসিনার পলায়ন
- ইনকিলাব ধ্বনিতে মুখরিত বাংলাদেশ।
- আরো হত্যা করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন হাসিনা।
- মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ কর্মকর্তাদের খোঁজে গোয়েন্দারা।
- মুক্তি পেলেন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া।
- আয়নাঘর থেকে মুক্ত হলেন আমান আযমী।
- যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় পাননি শেখ হাসিনা।
লণ্ডন, ৬ আগস্ট – শেখের বেটি পালায়না, শেখ হাসিনা পালায়না বলে দম্ভ করে গণহত্যা করে দুইদিনের মাথায় ভারতে পালিয়ে গেছেন বাংলাদেশের অবৈধ ও অনৈতিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরিস্থিতি যখন নাগালের বাইরে, হাজার হাজার ছাত্র-জনতা গণভবনের দিকে ঢুকছেন’ গোয়েন্দা সংস্থার এমন তথ্য পাওয়ার পর সোমবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়ার পর তড়িঘড়ি আকাশপথে পলায়ন করেন তিনি। বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে দেশ ছেড়েছেন হাসিনা।
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর তাকে না পেয়ে উত্তেজিত জনতা গণভবনে আগুন দিয়েছে। সোমবার মধ্যরাতে ভবনের বাইরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। তবে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসকে দেখা যায়নি।
এদিকে মধ্যরাতেও গণভবন থেকে মালামাল নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়েছে।
গণভবনের পুরো এলাকা ছাত্র, ক্ষুদে শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দখলে ছিল। তাদেরকে বিভিন্ন স্লোগান দিতে শোনা গেছে। সেসব স্লোগানে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ক্ষোভ যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি ছিল বিজয়ের আনন্দও। হয়েছে লুটপাটও। ভেতরে-বাইরে কোনো নিরাপত্তাও দেখা যায়নি। বিকেল থেকে অনেক মানুষকে গণভবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে বাইরে বের হয়ে আসতে দেখা গেছে। যে যা পারছেন, সেটাই সঙ্গে নিয়ে যান। টেলিভিশন, ফ্রিজ, শাড়ি, সোফা, এসি, মাছ, ফ্যান, হাঁস, মিষ্টি, ফুলের টব কোনো কিছুই বাদ যায়নি।
আরো হত্যা করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন হাসিনা
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি সোমবার সকালেও বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে বলপ্রয়োগের কথা বলেছিলেন হাসিনা।
সেদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিভিন্ন বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে সেই বৈঠক হয়েছে। তখনো আরও বলপ্রয়োগ করে আন্দোলনকারীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। পদত্যাগ করতেও রাজি হননি।
ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ রোববার রাতে তার একজন উপদেষ্টাসহ কয়েকজন নেতা বোঝানোর চেষ্টা করেন। তারা বলেন, এই পরিস্থিতিতে সেনার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই একমাত্র পথ। কিন্তু রোববার রাতে শেখ হাসিনা তা মানতে চাননি। বরং সোমবার সকাল থেকে আরও কড়া কারফিউয়ের ব্যবস্থা করতে বলেন। কিন্তু সোমবার সকাল ৯ টার পর থেকে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। কারফিউ উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নামতে থাকেন। ১০টার মধ্যে ঢাকার রাস্তায় জমায়েত বড় হতে শুরু করে।
সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ তিন বাহিনীর প্রধান এবং পুলিশের মহাপরিদর্শককে গণভবনে ডাকা হয়। শীর্ষ কর্মকর্তাদের সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা। বলেন, সামরিক বাহিনীর গাড়িতে উঠে লাল রং দিচ্ছে আন্দোলনকারীরা। কেন বাহিনী আরও কঠোর হচ্ছে না। পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করেন তিনি। কিন্তু মহাপরিদর্শকও জানান, এভাবে আর কঠোর অবস্থান নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পরিস্থিতি হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে।
এরপরেই হাসিনাকে তারা বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু হাসিনা তখনও তা মানতে চাইছিলেন না। এরপর অন্য একটি ঘরে রেহানার সঙ্গে কথা বলেন কর্মকর্তারা। তার কাছে অনুরোধ করা হয় হাসিনাকে বোঝানোর জন্য। একসময় ফোনে হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গেও কথা বলেন কর্মকর্তারা। এরপর ছেলের সঙ্গে কথা হয় হাসিনার। তারপর তিনি পদত্যাগ করতে রাজি হন। জাতির উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ রেকর্ড করতে চান তিনি।
এই সময়েই গোয়েন্দাদের কাছ থেকে খবর আসে যে বিপুল পরিমাণ জনতা গণভবনের দিকে আসছেন। ফলে হাসিনাকে ভাষণ রেকর্ড করতে দেওয়া হয়নি। ৪৫ মিনিটের মধ্যে গণভবন ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে বলা হয়।
এর কিছুক্ষণ পর তেজগাঁওয়ের পুরনো বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে যান হাসিনা। সেখানে তাদের কিছু জিনিসপত্র চপারে ওঠানো হয়। এরপর পদত্যাগের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারে দেশ ছাড়েন হাসিনা।
মন্ত্রী, এমপি ওপুলিশ কর্মকর্তাদের খোঁজে গোয়েন্দারা
প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা লাপাত্তা। খোঁজ নেই আওয়ামী লীগ দলীয় এমপিদেরও। এরইমধ্যে অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলেও খবর।
এদিকে মঙ্গলবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। দেশ পরিচালনায় গঠিত হতে যাচ্ছে অন্তবর্তীকালীন সরকার। তার মধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের খোঁজে নেমেছে গোয়েন্দারা। এসব পলাতক মন্ত্রী-এমপি-প্রভাবশালী নেতাদের খোঁজে তাদের বাড়িসহ আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গোয়েন্দা নজরদারি চলছে।
শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের পাশাপাশি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়েও যেসব উর্ধ্বতন বর্তমান-সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা নানা রকম অপকর্মে লিপ্ত ছিল তাদেরও খোঁজ চলছে।
রাষ্ট্রপতি কার্যালয় সূত্র বলছে, পুলিশের আইজিসহ শেখ হাসিনা সরকারের চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া একাধিক আমলার চাকরি চলে যাচ্ছে। এই ধরনের সকল চুক্তিভিত্তিক নিয়োগই বাতিল করা হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের যেমন খোঁজ মিলছে না, তেমনি বিদায়ী সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদেরও খোঁজ মিলছে না। লাপাত্তা আওয়ামী লীগ দলীয় এমপিদের অনেকেই।
অন্যদিকে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপিদের অনেকে এখনো গোপনে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বেশিরভাগেরই ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বার বন্ধ। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ অনেক মন্ত্রী-এমপি রবিবার রাতেই সিঙ্গাপুর চলে গেছেন।
অনেক প্রভাবশালী গত ১৪ জুলাই থেকে বিদেশি চ্যানেলের মাধ্যমে ফ্লাইটের টিকিট কেটে রেখেছিলেন। তারাও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে বিমানবন্দর সূত্র জানিয়েছে। এমন দেশত্যাগী মন্ত্রী, এমপি ও নেতার সংখ্যা শতাধিক। তারা ভারত, থাইল্যান্ড, চীন, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া ও দুবাই পাড়ি জমান।
এদিকে শেষ মুহুর্তে পালাতে না পারা অনেকে এখন বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছেন। সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক ও হাসান মাহমুদ দেশ ছাড়তে গিয়ে বিমানবন্দরে আটক হয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, শেখ হাসিনা সরকারের অন্য মন্ত্রী-এমপিসহ যারা দেশ ছাড়ার চেষ্টায় রয়েছেন তাদের বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এদের অনেকে আটক হতে যাচ্ছেন বলেও নির্ভরশীল সূত্র জানায়।
মুক্তি পেলেন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া
বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেলে রাষ্ট্রপতির প্রেস উইংয়ের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনী প্রধান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও বিভিন্ন মামলায় আটকদের মুক্তি দেওয়া শুরু হয়েছে এবং এরইমধ্যে অনেকে মুক্তি পেয়েছে।
আয়নাঘর থেকে মুক্ত হলেন আমান আযমী
দীর্ঘ ৮ বছর পর আয়নাঘর থেকে মুক্ত হলেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির প্রয়াত গোলাম আজমের মেজো ছেলে সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী। মঙ্গলবার জামায়াতে ইসলামের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
অপর দিকে দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পর খোঁজ মিলেছে দলটির সাবেক কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাশেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আরমানের। মঙ্গলবার জামায়াতে ইসলামের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
ওই পোস্টে বলা হয়, আলহামদুলিল্লাহ! শহীদ মীর কাসেম আলী রাহিমাহুল্লাহ এর সুযোগ্য সন্তান ব্যারিস্টার আহমাদ বিন কাসেম (আরমান) ফিরে এসেছেন। আল্লাহ তায়ালা যেন সকল গুমকৃতদের আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেন।
যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় পাননি শেখ হাসিনা
সোমবার সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ ভারতের রাজধানী দিল্লির উপকণ্ঠে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে হিন্ডন বিমান ঘাঁটিতে নামে শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান। এই এয়ারবেসটি এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম। বিমান বাহিনীর ওয়েস্টার্ন এয়ার কমান্ড এয়ারবেসটির দেখভাল করে থাকে। একটি সূত্রের দাবি, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি মালবাহী (কার্গো) বিমানে শেখ হাসিনা গাজিয়াবাদে নামেন। জল্পনা ছিল যে, দিল্লি বিমানবন্দরে অবতরণ করবে শেখ হাসিনার বিমান। কিন্তু পরে জানা যায়, দিল্লি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ না করে রাজধানী লাগোয়া গাজিয়াবাদের বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করেছেন শেখ হাসিনা। প্রথমে শোনা গিয়েছিল, সোমবার রাতেই তিনি লন্ডনের উড়ান ধরতে পারেন। তার পরে জানা যায়, বৃটেন তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে।
Share this content:
Post Comment