দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিতে বিএনপি

- বগুড়ায় বিএনপির ২৭ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ।
- শেরপুরে মাসে কয়েক কোটি টাকা চাঁদা তুলছেন বিএনপি নেতা শফিকুল মাসুদ।
আবদুল ওয়াহিদ তালিম, স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশে কোনো একটি সরকার পরিবর্তনের পর ব্যক্তির বদল ঘটলেও দুর্নীতি, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি কিংবা দখলের যে পুরনো ব্যবস্থা, সেটার পরিবর্তন খুব একটা হয় না। এবার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও কমবেশি একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, প্রভাব খাটানো এমনকি দখলের মতো অভিযোগ উঠছে বিশেষত বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। যদিও অন্তবর্তীকালীন সরকার তো বটেই খোদ বিএনপির শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে এ ধরনের ঘটনায় কোনো ছাড় না দেয়ার কথা। কিন্তু এতে করে কি চাঁদাবাজি আর দখল বন্ধ হয়েছে? বাস্তবতা অবশ্য সেটা বলছে না। ঢাকার বাইরে যেমন দখল, চাঁদাবাজির চিত্র আছে তেমনই একই অভিযোগ আছে ঢাকার ভেতরেও। ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে বিহারি ক্যাম্পের কাছেই রাস্তা এবং ফুটপাতের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছিলো শ্রমিক লীগের একটি কার্যালয়। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর সেই কার্যালয়ের দখল নিয়েছে মোহাম্মদপুর থানা যুবদল। আওয়ামী লীগের অফিস এখন বিএনপির দখলে।
বগুড়ার ধুনট উপজেলায় মাসব্যাপী গ্রামীণ আনন্দ মেলায় মারপধরের ঘটনায় দুই ইউপি চেয়ারমানসহ বিএনপির ২৭ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া এই মেলা বন্ধের দাবিতে রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরের পর গোলাম মোস্তফা মুকুলসহ ৪৩৩ জন এলাকাবাসী জেলা পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত আবেদন করেছে।
পৃথক দুটি অভিযোগে আসামিরা হলেন উপজেলার গোসাইবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুদুল হক বাচ্চু, ভান্ডারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন বাবু, ভান্ডারবাড়ী ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মাদ আলী, মন্নাফ সরকার, ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম, জহুরুল ইসলাম।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ভান্ডারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন বাবুর নামে রামকৃষ্ণপুর গ্রামে আনন্দ মেলার অনুমতি নেওয়া হয়। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের কার্যলয় থেকে এই মেলার অনুমতি নিয়েছে আয়োজক কমিটি। মেলা আয়োজনের কার্যক্রম চলাকালে শনিবার উপজেলার ভান্ডারবাড়ী ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ভূতবাড়ী গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম ও তার লোকজন মেলায় অশ্লীল নাচগান পরিবেশনে নিষেধ করে। এ ঘটনা নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে মারামারিতে ২ জন আহত হয়। এ ঘটনায় বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে শনিবার রাতে থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগে ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল হক বাচ্চা ও বেলাল হোসেন বাবুসহ বিএনপির ১৩ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। বাদী অভিযোগে মারধর করে ৭৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার কথা উল্লেখ করেন। মেলা আয়োজক কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আশিক আহমেদ বাদী হয়ে ১৪ জনের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। ওই অভিযোগে ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমসহ বিএনপির ১৪ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। বাদী অভিযোগে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির কথা উল্লেখ করেন। ধুনট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইদুল আলম বলেন, অভিযোগ দুটি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে ‘শেরপুরে মাসে কয়েক কোটি টাকা চাঁদা তুলছেন বিএনপি নেতা মাসুদ’ শিরোনামে গত ২৮ জানুয়ারি দৈনিক খবরের কাগজে এক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। কামরুজ্জামান মিন্টু’র করা সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নানা অপকর্মে জড়িয়েছেন শেরপুর জেলা যুবদল সভাপতি ও জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মাসুদ। গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বিব্রত করছেন শেরপুর জেলা বিএনপিকে। আওয়ামী পরিবারের সন্তান হয়েও রাজনীতিতে নাটকীয় উত্থানে এখন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর জামালপুর ব্রিজের ১০০ গজের ভেতর অবৈধভাবে বালু তোলা, কাঁচাবাজার দখল, গরুর হাট দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করে আসছেন শফিকুল ইসলাম মাসুদ। মাসে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করছেন তিনি। চাঁদার ভাগ যাচ্ছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের পকেটেও।
অভিযোগ রয়েছে, অবৈধভাবে বালু তোলার পাশাপাশি কৃষকের জমি দখলও করে নিয়েছেন এই মাসুদ। ভুক্তভোগীরা ভয়ে কোথাও বিচার দেওয়ার সাহসটুকুও পাচ্ছেন না। দলে যুবদল কিংবা বিএনপির হলেও শফিকুল ইসলাম মাসুদের মননে আওয়ামী লীগ। তার বাবা আবদুল লতিফ শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে রিলিফ চেয়ারম্যান ছিলেন। মাসুদের দুই ভাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। তার আপন চাচাতো ভাই আকবর চেয়ারম্যান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সরাসরি অংশগ্রহণকারী আকবর। পরে হত্যা মামলার আসামি হয়ে পলাতক রয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে শফিকুল ইসলাম মাসুদ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেন। পরে বিএনপিতে ফিরে আসেন। তার চাচাতো ভাই আকবর চেয়ারম্যানের পক্ষে শফিকুল ইসলাম মাসুদ তিনবার নৌকা মার্কার নির্বাচনি প্রচার চালান এবং বিএনপির দলীয় ইউনিয়নে প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও তার অনুসারীদের বিরোধিতা করতে বলেন।
আকবর চেয়ারম্যান ছাত্র আন্দোলনে বিরোধিতাকারীদের একজন। তিনি অবৈধ বালু ব্যবসা, জমি দখল, বাজার দখল, ব্রহ্মপুত্র ব্রিজের পাড়ে ১০০ গজ ভেতরে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অবৈধ বালু তোলাসহ যাবতীয় অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আওয়ামী লীগের পতনের পর শফিকুল ইসলাম মাসুদ অবৈধ এই বালু ব্যবসার হাল ধরেছেন বলে অভিযোগ ওঠে।
শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের পতনের পর শেরপুরে জেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে যুবদল নেতা মাসুদের বিরুদ্ধে। বর্তমানে শ্রীবরদী পৌরসভার মেয়র এবং তার ছেলের ঠিকাদারি কাজের দায়িত্ব পরিচালনা করছেন জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদ।
স্থানীয় বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শফিকুল ইসলাম মাসুদ আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিয়েছেন। বিভিন্ন সভায় আওয়ামী লীগের লোকদের বিএনপিতে যোগ দেওয়াচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে বিএনপির জন্য তা ক্ষতিকর হয়ে যাবে।’
জেলা বিএনপির একজন নেতা বলেন, ‘শফিকুল ইসলাম মাসুদের কোনো জনসম্পৃক্ততা নেই। তিনি একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন। তিনি বিএনপির মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টির পাশাপাশি আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার ষড়যন্ত্রে সম্পৃক্ত।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শেরপুর জেলা যুবদলের সভাপতি ও বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা মিথ্যা। কেউ শত্রুতাবশত এ সব তথ্য ছড়াচ্ছে।’
নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ‘সিস্টেম বদলে দেয়া’র কথা। এ বিষয়ে সরকারের উপর ছাত্র-জনতারও চাপ আছে। কিন্তু বাস্তবে কতটা কী হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
Share this content:
Post Comment